ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা

গাইড বেচতে শিক্ষক প্রকাশক চুক্তি

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গাইড বেচতে শিক্ষক প্রকাশক চুক্তি

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৪ সেপ্টেম্বর ॥ দেশের মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতে এখনও তিন মাস বাকি। গাইড প্রকাশকরা এখনই নতুন শিক্ষাবর্ষকে টার্গেট করে গাইড বই বিক্রিতে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রকাশদের প্রতিনিধিরা স্কুলে স্কুলে গাইড বই বিক্রিতে প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে ডোনেশন চুক্তি করছে। এ ডোনেশন সারা দেশে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে গাইড নির্ভরশীলতা সরকারের সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে বলে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন। দেশে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষবর্ষ শুরু হয়। নতুন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে নবপুথিঘর, পাঞ্জেরী, নবদূত, বইঘর, অনুপম, গুরুগৃহ, জুপিটার, আল-ফাতাহ, আলফা, সামছাদ, পপি পাবলিকেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিষয়ভিত্তিক ১ম শ্রেণী থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত গাইড প্রকাশ করছে। বাংলা, ইংরেজী, বাংলা ব্যাকারণ, ইংরেজী ব্যাকারণ, অর্থনীতি, ধর্র্ম, সামাজিক বিজ্ঞান, কম্পিউটার শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, ব্যবসায় উদ্যোগ, হিসাববিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানসহ বিষয়ভিত্তিক এই গাইড বাজারজাতকরণে প্রকাশকরা সারাদেশের প্রধান শিক্ষকদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। স্কুলে স্কুলে ডোনেশনের নামে করা হচ্ছে অনৈতিক চুক্তি। স্কুলের ছাত্র সংখ্যাভিত্তিক এ ডোনেশনের টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে স্কুলপ্রতি ৫০ হাজার থেকে আগাম দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ডোনেশন দেয়া হচ্ছে। আবার কোন কোন প্রকাশক ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত শুধু বাংলা ও ইংরেজী ব্যাকারণ চালাতে স্কুলপ্রতি ১ লাখ ৩০-৪০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ডোনেশন দিচ্ছে। সারা দেশে এ ডোনেশন ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। শুধু ডোনেশনই নয়, তার সঙ্গে সারা বছরের সকল পরীক্ষার প্রশ্ন ফ্রি দেয়ারও চুক্তি হচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরিতে অনেক সময় লাগার কারণে অনেক স্কুলেই ফ্রি প্রশ্নের সুবিধা নিচ্ছে। প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে ডোনেশন চুক্তি ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক যেসব শিক্ষকের প্রচুর টিউশনি রয়েছে তাদের সঙ্গেও গাইড চালানোর শর্তে প্রকাশকরা পৃথক টাকার চুক্তি করছে। কোন কোন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা প্রভাবশালী সদস্যদের সঙ্গে প্রকাশকরা চুক্তি করছে। এসব সভাপতি সদস্যরা ওই স্কুলে নির্ধারিত প্রকাশকদের গাইড চালাতে বাধ্য করছেন বলেও জানা গেছে। কোন কোন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডোনেশনের টাকা একাই আত্মসাত করায় স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষের খবর মিলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে গাইডের দাম ধরা হয়েছে ৬৫০ টাকা তার বাস্তবে দাম পরে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। প্রকাশকরা গাইডপ্রতি দ্বিগুণ বা তিনগুণ দাম বেশি ধরছে। বাড়তি এ টাকা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের পকেট থেকেই প্রকাশকরা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন ১ম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্ররা সবাই গাইড নিয়ে স্কুলে আসছে। আবার অনেক শিক্ষক গাইড বই ক্লাসে পড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল বই পড়াতে হলে শিক্ষকদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পড়াতে হয়। আর এ জন্য শিক্ষকদের পড়ালেখা করে স্কুলে আসতে হয়। অনেক শিক্ষক বাড়িতে এতই টিউশনিতে ব্যস্ত থাকেন, পড়াশুনার সময় তাদের হয় না। তাই শিক্ষকরা ক্লাসে গাইড বই পড়ান। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র শিক্ষকদের গাইড নির্ভরতা প্রসঙ্গে আরও জানিয়েছেন, বর্তমান নিয়মে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৯ম শ্রেণীর ইংরেজী ১ম পত্র প্রশ্ন মূল বই থেকে ৩০ ভাগ নেয়া হয়। অবশিষ্ট ৭০ ভাগ প্রশ্ন বাইরে থেকে নেয়া হয়। ১ম পত্রের প্রশ্ন ইনফরমাল লেটার, প্যারাগ্রাফ, সেন্টেন্স মেকিং মূল বই থেকে নেয়া হয় না। বাংলা ব্যাকারণ ২য় পত্রে মূল বইয়ে বাংলা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ নেই বললেই চলে। ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজী ২য় পত্রে প্যারাগ্রাফ, ন্যারেশন, সেন্টেন্স পরিবর্তন মূল বইতে নেই বললেই চলে। পরীক্ষায় কমন পেতে শিক্ষকরা তাই গাইড বইয়ের আশ্রয় দিচ্ছেন। ওই সূত্রে ছাত্রছাত্রীদের গাইড নির্ভরশীলতা সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগে বড় বাধা বলে দাবি করেন। এ ছাড়াও গাইড প্রকাশকরা প্রতি কলেজকে টার্গেট করে বিষয়ভিত্তিক গাইড চালাতে বিপুল অঙ্কের চুক্তি করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
×