ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ॥ কী বলছে আনান কমিশন!

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ॥ কী বলছে আনান কমিশন!

সমস্যাটি পুরনো। ইতিবাচক অগ্রগতিটি হলো; যারা সমস্যাটি সৃষ্টি করেছেন তারা সমস্যার গভীরতাটি বুঝতে পেরেছেন এবং সমাধানের জন্য নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছেন। এ পর্যন্ত এসে সমাপনী মন্তব্যটি করা গেলে খুবই ভাল হতো। কিন্তু নাফ নদে অনেক জল শুধু গড়ায়নি, হায়েনাদের ছোবলে সেই জল রক্তবর্ণ হয়েছে, মাছ নয় ভেসে উঠছে মৃত রোহিঙ্গাদের লাশ; ঘটনার সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত না হয়েও সমস্যার ভারে জবুথবু বাংলাদেশ। যে পর্যায়ে এসে এই লেখা সেই পর্যায়ে সমস্যার সমাধান সূত্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হচ্ছে নতুন দাবি : রাখাইন রাজ্যে যারা গণহত্যা চালিয়েছে তাদের বিচার করতে হবে। সমস্যার গভীরতার এই পর্যায়ে এসেও যেহেতেু সমাধান খুঁজতেই হবে; সেহেতু মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আপাতত; জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের রিপোর্ট ও তাদের ৮৮ দফা সুপারিশকেই সমাধান সূত্র বলে মানছেন সবাই। ইতিবাচক দিকটি হলো: এই কমিশন বা সুপারিশগুলো কোন চাপিয়ে দেয়া বিষয় নয়। আর সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকার যে আগ্রহ দেখিয়েছে তাতেও কোন আন্তর্জাতিক চাপ ছিল না। কোফি আনান কমিশন কিভাবে হলো ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির আনুষ্ঠানিক অনুরোধে কোফি আনান ফাউন্ডেশন এবং সুচির দফতর যৌথভাবে রাখাইন রাজ্যের জন্য উপদেষ্টা কমিশন নামে এই কমিশন গঠন করে। নয় সদস্যের এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান, অপর আট সদস্যের মধ্যে ৬ জন মিয়ানমানের; নাগরিক বাকি দু’জন আন্তর্জাতিক সদস্য। এটিই কোফি আনান কমিশন নামে পরিচিত লাভ করে। কেন এই কমিশন কমিশনের কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়: তারা রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করবে এবং সেখানে যে সহিংসতা হচ্ছে, মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে ও সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করবে, পাশাপাশি কমিশন এই অঞ্চলের অনুন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করবে। এই কাজ সম্পাদনের জন্য কমিশনকে সময় বেঁধে দেয়া হয় এক বছর। কমিশন কিভাবে কাজ করেছে এই দায়িত্ব পালন করার জন্য কমিশন বড় দাগে তাদের কাজের পাঁচটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করে। এগুলো হচ্ছে সংঘাত নিরসন, মানবিক সাহায্য, পুনরেকত্রীকরণ, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং উন্নয়ন। আউং সান সুচির অনুরোধে কমিশন রিপোর্টে ‘রোহিঙ্গা’ বা ‘বাঙালী’ পরিচিতিটি ব্যবহার করেনি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয়েছে ‘মুসলিম’ বা ‘রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী।’ ‘কামান’ বলে যে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে চিহ্নিত এই রিপোর্টে তাদের কথা বলা হয়নি। কার্যকালে কমিশন রাখাইন রাজ্য সরকার, রাখাইন পার্লামেন্ট, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি সংগঠন, গ্রামের সমাজপতি, বেসরকারী খাতের প্রতিনিধি, বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, রাজ্যেও প্রধান দুই সম্প্রদায় ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর (কামান, চীনা, হিন্দু এবং ম্রো) প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কমিশন মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি, স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি, সেনাবাহিনী প্রধান এবং রাখাইন রাজ্যে শান্তি স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সমস্যার জটিলতা বুঝতে মিয়ানমারের সীমা ছাড়িয়ে রাখাইন রাজ্যের সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হলেও তার প্রভাব পড়েছে আঞ্চলিক পর্যায়ে। সে কারণে আনান কমিশন সমস্যার গভীরতা বোঝার জন্য এই সমস্যার সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষতভাবে জড়িয়ে পড়া দেশগুলোর সঙ্গেও মতবিনিময় করে। বাংলাদেশ সফরকালে কমিশন সদস্যরা কক্সবাজোরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং ঢাকায় উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। ব্যাঙ্ককে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও কমিশন চেয়ারম্যান ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কমিশনের সদস্যরা ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি ছাড়াও জাতিসংঘ কর্মকর্তা, মিয়ানমারভিত্তিক নানা আন্তর্জাতিক সহায়তা গোষ্ঠী, এনজিও, আঞ্চলিক সংস্থা এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কমিশন মিয়ানমার ও রাখাইনের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও ঢাকা, কক্সবাজার, ব্যাঙ্কক, জেনেভায় ১৫৫টি বৈঠক করেন এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ১১০০ জনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। শুরু থেকেই নানামুখী জটিলতা একটি শুভ ইচ্ছা থেকে এই কমিশন গঠন করা হলেও শুরু থেকেই এই কমিশনকে নানা চড়াই-উৎরাই পথ পাড়ি দিতে হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সনের আগস্ট পর্যন্ত কমিশনের কার্যকালে মাঝে মধ্যেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। রাখাইনে যেমন নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে পাশাপাশি কমিশনের কাজে বিঘœ সৃষ্টির জন্য নানা প্রকাশ্য তৎপরতাও চালানো হয়েছে। কমিশন কাজ শুরুর সময়েই মিয়ানমার পার্লামেন্টে এই কমিশন নিষ্ক্রিয় করার জন্য প্রস্তাব আনা হয়। ওই প্রস্তাবটির পক্ষে অবস্থান নেয় আরাকান ন্যাশনাল পর্টি, সেনা সমর্থিত বিরোধী দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডি) এবং পার্লামেন্টে সেনাবাহিনী থেকে মনোনীত ১১০ জন সদস্য। দেখা যাচ্ছে বেসামরিক নেতা আউং সান সুচি এই কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিলেও শুরু থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক দল এবং উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সুচির দলের দৃঢ় অবস্থানের কারণে কমিশন নিষ্ক্রিয় করার এই প্রস্তাবটি জাতীয় পার্লামেন্টে পাস হয়নি। কিন্তু মধ্য সেপ্টেম্বরে রাখাইন রাজ্য পার্লামেন্টে প্রায় একই ধরনের একটি প্রস্তাব পাস হয়, ফলে রাখাইন রাজ্য পর্যায়ে কেউ কেউ আনুষ্ঠানিকভাবেই এই কমিশনকে বয়কট করে। অন্যদিকে কমিশন গঠনের মাত্র এক মাসের মধ্যে ২০১৬ সালে অক্টোবর মাসে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। এত ঝুট ঝামেলা অতিক্রম করে প্রায় এক বছর ধরে কাজ করে এই কমিশন। অন্তর্বর্তী রিপোর্ট ও মিয়ানমারের আগ্রহ ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ কমিশন অন্তর্বর্তী রিপোর্ট ও সুপারিশমালা হস্তান্তর করে। মিয়ানমার সরকার এই সুপারিশগুলো জনসন্মুখে প্রকাশ করে এবং এর বেশিরভাগ বাস্তবায়নেই তাদের আগ্রহের কথা জানায়। সে সময়ই মিয়ানমার সরকার ঘোষণা দেয় যেহেতু রাখাইন রাজ্যের সমস্যার জন্য বাংলাদেশে অনেক শরণার্থী ঢুকে পড়েছে সে জন্য সমস্যা সমাধানে একটি যৌথ কমিশন গঠন করা হবে, যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কথা তখন মিয়ানমারের পক্ষ থেকেই বলা হয়। কমিশনের অবস্থান রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানে কমিশনের অবস্থান তুলে ধরে কমিশনের চেয়ারম্যান তার সূচনা বক্তব্যে লিখেছেন : আউং সান সুচি তাদের একটি জোরালো সুপারিশ দেয়ার কথা বলেন; সে জন্য নানা জটিলতার মধ্যেও কমিশন সাহসিকতার সঙ্গে সেই কাজটি করে। কমিশন কঠোর নিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন রাখাইন রাজ্যের জনগোষ্ঠীর দুঃখ দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে তেমনি এর সমাধানের জন্য সুদূরপ্রসারী সুপারিশমালাও তুলে ধরে। কমিশন মনে করে এই কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মূল দায়টি হচ্ছে : মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ও রাখাইন রাজ্য সরকার, জাতীয় ও রাজ্য পার্লামেন্ট, ধর্মীয় ও কমিউিনিটি নেতারা সর্বোপরি রাখাইন রাজ্যের জনগণের। কমিশন প্রস্তাব করে : এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যেন এমন একটি পদ্ধতি বের করে যাতে ধারাবাহিকভাবে এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের পথটি সুগম হয়। কমিশন নিজেও এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেছে যে: এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে জন্য কমিশন মিয়ানমারের কমান্ডার-ইন-চীফ, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হলেইঙ্গ এবং সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গেও দফায় দফায় বৈঠক করে। কমিশনের ভাষ্যে নেপথ্য চিত্র রাখাইন সমস্যা নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। এই বিভ্রান্তির কিছুটা অজ্ঞতাপ্রসূত, বেশিরভাগই পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক। আনান কমিশন বিস্তর গবেষণা শেষে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছে : রাখাইন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৩০ সালে, তখন এর রাজধানী ছিল মারুক ইউতে এবং বাংলার সুলতানদের সঙ্গে এই রাজ্যের চমৎকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ১৭৮৪-৮৫ সালে সেখানে বর্মার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৮২৪-১৮২৬ ব্রিটিশ-বার্মিজ যুদ্ধের সময় রাখাইন চলে যায় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। বার্মিজ নিয়ন্ত্রণের আগে থেকেই রাখাইনে মুসলমানরা বসবাস করত, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই গবেষণায় যে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয় : রাখাইনে মুসলমানদের বসবাস ১৯৮৪ সালেরও আগে থেকে এবং বার্মিজরা সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে যাওয়ার আগে থেকেই। ব্রিটিশ রাজত্বকালে তারা কৃষি কাজ, বিশেষত ধানচাষের দিকে নজর দেয়। সে জন্য প্রচুর শ্রমশক্তির প্রয়োজন হলে বেঙ্গল থেকে বহু শ্রমিক সেখানে কাজ করতে যায়। তবে বেশিরভাগই যায় মৌসুমী কাজ করতে, অনেকে আবার স্থায়ী বসতিও গড়ে সেখানে। ১৮৮০ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়কালে রাখাইনে মুসলিম জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এ নিয়ে রাখাইন এবং মুসলিমদের মধ্যে কোন বৈরিতা ছিল না। মূলত উনিশ শতক থেকে মুসলিম-বৌদ্ধ দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৪২-৪৩ সালে ব্রিটিশ-জাপান যুদ্ধে দুই সম্প্রদায়ই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০১২ সাল থেকে। এর নেপথ্যে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের ইন্ধন আছে বলে দাবি বিভিন্ন মহলের। চলবে... লেখক : সাংবাদিক প্রধান সম্পাদক- একুশে টেলিভিশন
×