ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

রোহিঙ্গা সমস্যা ও শেখ হাসিনার ভাষণ

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যা ও শেখ হাসিনার ভাষণ

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষণ দিয়েছেন তা পাঠ করে বহুকাল আগের দুটি ভাষণের কথা মনে পড়েছে। একটি দিয়েছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। তখন মহাযুদ্ধে ব্রিটেন সম্পূর্ণ একা। রাশিয়া তখনও যুদ্ধে নামেনি। ফ্রান্স জার্মানির কাছে পরাজিত এবং আমেরিকা দূরে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষতা দেখাচ্ছে। শুধু লন্ডন শহরের ওপর পড়ছে জার্মানির ভয়ানক মারণাস্ত্র ভি-রকেট বোমা। মনে হয়েছিল ব্রিটেনের পরাজয় বুঝি আসন্ন। এই সময় চার্চিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তার ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। তখন পার্লামেন্ট হাউসের মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে জার্মান বোমারু বিমান উড়ছে। বোমা ফেলছে। পার্লামেন্টের একাংশ বোমায় বিধ্বস্ত, তবুও চার্চিল এবং বহু এমপি পার্লামেন্ট ভবন ছাড়েননি। চার্চিল নির্ভয়কণ্ঠে বক্তৃতা দিয়েছেন ‘আমরা সমুদ্র সৈকতে সম্পূর্ণ একা, কিন্তু আমরা ভীত নই। নাৎসীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ চালিয়ে যাব এবং অবশ্যই জয়ী হব।’ বক্তৃতা শেষে তিনি দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে ভি বা ভিক্টরি চিহ্ন দেখিয়েছিলেন। আমরা যখন স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্র অর্থাৎ এই ভাষণ দানের আট-দশ বছর পর, এই ভাষণটি আমাদের ইংরেজী পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ ছিল। এর শিরোনাম ছিল ‘অষড়হব রহ ঃযব নবধপয (সমুদ্র সৈকতে একা)।’ চার্চিলের এই ভাষণটি পড়ে সেই কিশোর বয়সেও মনে মনে শিহরিত হয়েছি। তারপর ১৯৫৬ সালে আমি যখন যুবক এবং সাংবাদিকতা করি তখন আরেকটি ভাষণ শুনে আবারও মনে উদ্দাম শিহরণ অনুভব করেছি। এই ভাষণটি মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের। মিসর তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইল দ্বারা দারুণভাবে আক্রান্ত। কায়রোয় বৃষ্টিপাতের মতো তিন দেশের বোমারু বিমান অনবরত বোমা ফেলছে। মিসরের পাশে তখন পর্যন্ত কেউ নেই। ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এন্থনি ইডেন গর্জন করছেন, তিনি নাসেরের কল্লা নেবেনই। ওই সময়ও নাসের অনবরত জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণ কখনও রেডিওতে, কখনও রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা লাউড স্পিকারে প্রচারিত হয়েছে। প্রচণ্ড বোমা বর্ষণ সেই ভাষণ বন্ধ করতে পারেনি। ওই ভাষণে নাসের প্রতি পঁাঁচ মিনিট অন্তর উচ্চারণ করেছেন কোরানের আয়াত-‘নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারীব (হে বিশ্বাসী তোমরা নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র সাহায্য এবং বিজয় তোমাদের সন্নিকটবর্তী)।’ এই যুদ্ধ ছিল সুয়েজ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধের ফলাফল আমার পাঠকদের জানা। রাশিয়ার ক্রুশচেভের এক ধমকে এই তিনটি আক্রমণকারী দেশকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছিল। নাসেরের জয় হয়েছিল। তার পতন হয়নি, পতন হয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইডেনের। বাংলাদেশ বর্তমানে যে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে তাকে আমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন চার্চিলের সঙ্কট এবং সুয়েজ যুদ্ধকালীন নাসেরের সঙ্কটের চাইতে কম জটিল সঙ্কট মনে করি না। বাংলাদেশ একদিকে প্রবল বন্যা আক্রান্ত, লাখ লাখ বানভাসি মানুষের দুর্গতি লাঘবে সরকার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন, ঠিক এই সময় প্রতিবেশী মিয়ানমারে শুরু হয়েছে গণহত্যার পুনরাবৃত্তি। লাখ লাখ মানুষ বন্যার পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকছে। দেশটির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর এটা একটা ভয়ানক চাপ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কিত রায়কে কেন্দ্র করে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটা প্রচণ্ড বিরোধ লাগিয়ে দিয়ে। দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শত্রুরা ভেবেছিল এই তিন সঙ্কটের ধাক্কায় হাসিনা সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা মোটেও সম্ভব হবে না। তখন তাদের পোয়াবারো। এই ভেবে তাদের মধ্যে ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন তিনি নারী হলেও তার মধ্যে চার্চিলের সাহস, নাসেরের বিশ্বাস ও ধৈর্য রয়েছে। তিনি তিনটি গভীর সঙ্কটের দুটি প্রায় কাটিয়ে উঠেছেন এবং রোহিঙ্গা সমস্যাও, যা এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তা কাটিয়ে ওঠার সাহস ও ধৈর্য দেখাচ্ছেন। পার্লামেন্টের বর্তমান অধিবেশনে তিনি যে ভাষণটি দিয়েছেন, এক কথায় তা ঐতিহাসিক। সঙ্কট একদিন কেটে যাবে, কিন্তু এই ভাষণটি দীর্ঘকাল বাংলাদেশের মানুষের মনে জাগরূক থাকবে এবং ভবিষ্যতের যে কোন সঙ্কটে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগাবে। এই ভাষণে কোন হুমকি নেই, কোন লোকরঞ্জক কথা নেই, যা আছে তা হলো পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণ এবং সমস্যা সমাধানের ইতিবাচক প্রস্তাব। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মণির সুপারিশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে আলোচনা করেছিলেন এবং সকলকে অভয় দিয়ে যে কথাটি বলেছেন তা রোহিঙ্গার নিপীড়িত শরণার্থীদের এবং বাংলাদেশের মানুষের মনে সাহস যোগাবে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি ষোলো কোটি মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে আগত তিন-চার লাখ মানুষেরও খাদ্য, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারব।’ তার কণ্ঠে এই প্রত্যয়দীপ্ত কথা শুনে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মতো এই সুদূরে বসে আমারও মনে হয়েছে চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ রাজের মতো মহাশক্তিও অবিভক্ত বাংলাদেশে পঞ্চাশ লাখ লোককে অনাহারে মরতে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনা বর্তমানে কোন রোহিঙ্গাকে অনাহারে মরতে দেবেন না। সাম্রাজ্যবাদী চার্চিলের মনে ভারতের দুর্গত মানুষের জন্য সংবেদনশীল মানবতাবাদী মনোভাব ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার মনে আর্তমানবতার জন্য যে সংবেদনশীল মনটি লুকিয়ে আছে তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যাটির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং এই সমস্যা সমাধানের কথাও বলা হয়েছে। তা এক কথায় এই সংখ্যালঘু নাগরিকদের মিয়ানমার সরকারের উচিত নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া, তাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্যাতন বন্ধ করা এবং সেফ জোন সৃষ্টি করাসহ তাদের নিরাপদ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। শেখ হাসিনার ভাষণে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেত্রী অহিংসা ও মানবতার জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেও তিনি এখন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আপোস করে হয়ত তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসতে পারছেন না। ফলে তার দেশের মানুষের একাংশের ওপর সেনাবাহিনীর নির্মম নিপীড়ন চললেও তিনি তার বিপরীতে অবস্থান নিতে সক্ষম হচ্ছেন না। শেখ হাসিনা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং এই সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে মহত্ত্ব ও মানবতাবোধে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ ছোট একটি উন্নয়নশীল দেশ। তার পক্ষে এই দায় বহন করা কঠিন, তবু শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পক্ষে এই দায় বহনে সাহসের সঙ্গে এগিয়েছেন। বিদেশী সাহায্য আসছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। তুরস্কসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। জাতিসংঘ তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তবু এই লাখ লাখ মানুষকে সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার বড় দায়টি বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে। এ কাজটি সহজ নয়। তবু প্রধানমন্ত্রী উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ছুটে গেছেন এবং তাদের বাঁচার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের শুভেচ্ছা ও সহযোগিতা নিয়ে তিনি যে কাজটি পারবেন তাতে সন্দেহ নেই। তার এই সাহস ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব সংসদে দেয়া তার ভাষণেই প্রতিফলিত হয়েছে। হতে পারে বাংলাদেশ আজ সমুদ্র সৈকতে একা, কিন্তু হাসিনার নেতৃত্বে এই সঙ্কটেও তারা বিজয়ী হবেই। সংসদে দেয়া শেখ হাসিনার ভাষণের একটি বৈশিষ্ট্য এই ভাষণে মিয়ানমারের প্রতি কোন হুমকি যে নেই তা আগেই বলেছি। একদিকে তিনি আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন এবং অন্যদিকে মিয়ানমারের দিকে শান্তি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এমন কথাও বলেছেন রোহিঙ্গাদের ভেতরে যদি কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লুকিয়ে থাকে তাদের শাস্তি দেয়া হোক। সন্ত্রাস দমনে আমরাও সহযোগিতা করব। কিন্তু কিছু সন্ত্রাসীর কার্যকলাপের জন্য গোটা সম্প্রদায়কে শাস্তি দেয়া যায় না। নারী, শিশু নির্বিশেষে তাদের হত্যা করা চলে না। এটা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ। তিনি প্রতিবেশীসুলভ সৌহার্দ্যরে মনোভাব নিয়ে মিয়ানমারকে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই ধৈর্য ও সাহস সমস্যাটিকে আরও গুরুতর সঙ্কটে পরিণত হতে দেয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের যারা ভেবেছিল এই সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটা ধুন্ধুমার বেধে যাবে এবং তারা সেই আগুনে আলু পুড়িয়ে খাবেন, তাদের সেই ইচ্ছা যে পূর্ণ হবে না তা এখন স্পষ্ট। শেখ হাসিনার এই অভিযান শান্তির মশাল হাতে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার অভিযান, আর্তমানবতাকে রক্ষার অভিযান। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, ধৈর্য ও সাহস বিশ্বময় প্রশংসিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশিষ্ট একাডেমিক আবেদন জানিয়েছেন এবার যেন নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম সুপারিশ করা হয়। তারা এই ব্যাপারে নরওয়েজিয়ান নোবেল পুরস্কার প্রদানের সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমার ধারণা বর্তমান বিশ্বে শান্তি, অহিংসা ও মানবতার জন্য যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার দিতে হয় তাহলে শেখ হাসিনাই তার যোগ্যতম প্রার্থী। তাকে পুরস্কার দিয়ে অতীতে হিংসার বাহকদের এই পুরস্কার দানের দুর্নাম থেকে নোবেল পুরস্কার কমিটি বাঁচতে পারে। তাতে এই পুরস্কার প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের আত্মাও হয়ত শান্তি পাবে। লন্ডন, ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার ২০১৭
×