ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী নয় সরকারী চাকরিই বেশি নির্ভরযোগ্য

প্রকাশিত: ০৩:০৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বেসরকারী নয় সরকারী চাকরিই বেশি নির্ভরযোগ্য

আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বছর আগে যখন বাজার অর্থনীতি চালু হয় এবং বেসরকারীকরণ হয়, তখন সরকারী চাকরির কথা উঠলে সবাইকেই বলতাম বেসরকারী খাতে চাকরি করতে। তখন মনে হয়েছিল বেসরকারী খাত, বিশেষ করে সংগঠিত বেসরকারী খাতই হবে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত। সরকারী খাতে তখন বেতন কম, ভীষণ কম। উদীয়মান বেসরকারী খাতের চাকরির সঙ্গে সরকারী খাতের চাকরির মধ্যে বেতনের ছিল বেশ বড় তফাত। বোনাসের বালাই ছিল না। সংগঠিত বেসরকারী খাত যেমন ব্যাংক-বীমা এবং অন্যান্য সমজাতীয় খাতে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। গাড়ি-বাড়ির সুযোগ বেশি। এসব দেখে মনে হয়েছিল চাকরির জন্য বেসরকারী খাতই উপযুক্ত খাত। সরকারী খাতের ভবিষ্যত অন্ধকার। সরকার দিন দিন ছোট হবে। সরকার তার সম্পত্তি, ব্যাংক, বীমা, শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব ছেড়ে দেবে। যেহেতু বাজার অর্থনীতি, যেহেতু বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে তাই সরকার হবে ছোট একটা কাঠামো। তার কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অবকাঠামো গড়ে তোলা। ব্যবসা সরকারের কাজ নয়। সরকার কেন ব্যবসা করবে? ব্যবসা, শিল্প ইত্যাদি করবে ব্যক্তি, কোম্পানি। তারাই হবে দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। তারাই হবে ধন-সম্পত্তির মালিক। তারাই লোকের চাকরি দেবে নিশ্চিত যুব সম্প্রদায়ের দেখভাল করবে। গড়ে উঠবে মধ্যবিত্ত, যাদের থাকবে ক্রয় ক্ষমতা। আমদানি, রফতানি ব্যবসা করবে বেসরকারী খাত। অতএব বিরাট শ্রমশক্তি সেখানে লাগবে। এমতাবস্থায় কে যায় সরকারী চাকরি করতে যেখানে সৃজনশীলতা, উদ্যম ও মেধার কোন মূল্য নেই। যেহেতু নেই তাই বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধাও সেখানে কম। এই ভিত্তিতে যারাই চাকরির কথা বলত তাদেরই বলতাম, চাকরি করবে তো কর বেসরকারী খাতে। আজ যদি কেউ জিজ্ঞেস করে চাকরি কোথায় করা উচিত? আমি কী দ্বিধাহীন চিত্তে বলব, চাকরি কর তো কর বেসরকারী খাতে? না, এখন এ কথা বলার কোন সাহস পাই না। কেন? এখন কেউ যদি চাকরির কথা জিজ্ঞেস করে তাহলে বরং বলি চাকরি করতে হয় কর সরকারী খাতে। যেভাবে পার সরকারী চাকরিতে ঢোক। সরকারের আকার আমার ধারণা মোতাবেক ছোট হয়নি। সরকারের আকার দিন দিন বড় হচ্ছে। কম্পিউটারায়ন, প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি, মোবাইল ফোন ব্যবহার ইত্যাদি সত্ত্বেও সরকার ছোট হচ্ছে না। নতুন নতুন জেলা, বিভাগ, উপজেলা, থানা হচ্ছে। নতুন নতুন অফিস হচ্ছে। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে তো বাড়ছেই। কেউ দক্ষতার প্রশ্ন করে না। ওই আগের মতোই। পাকিস্তান আমলে বলা হতো আসলে গেলে বেতন পাই, কাজ করলে ওভারটাইম পাই। বেসরকারী খাত ও সরকারী খাতের মধ্যে বেতন-ভাতার পার্থক্য বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বেসরকারী খাতের সুবিধা যেমন গাড়ি-বাড়ির সুযোগ সরকারী খাতে আছে। বোনাসের ব্যবস্থা হয়েছে। এমনকি পহেলা বৈশাখেও ‘ইলিশ’ বোনাস পাওয়া যায়। পদোন্নতির কোন সীমা নেই। ‘পদ’ না থাকলেও পদোন্নতি হয়। চাকরি যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরের চাকরি ঢাকা থেকে করা যায়। জেলখানায় চাকরি করে কয়েদিদের খাবার না দিলেও চলে। অথচ বিপরীতে বেসরকারী খাতে এখন যখন-তখন চাকরি যায়। ‘লাইফলং’ এম্পøয়ম্যান্ট বলতে কিছু নেই। অবসর গ্রহণ করা বলে কিছু থাকছে না। সরকারী চাকরিতে অবসর আছে। মৃত্যুর পর পেনশন বংশ পরম্পরায় চলার মতো অবস্থা! বড় পদ হলে অবসরের পর গাড়ি-বাড়িসহ ‘চেয়ারম্যান’Ñ কত রকমের ব্যবস্থা। সরকারী চাকরি সরকারের অংশীদারিত্ব। বেসরকারী চাকরি তা নয়। বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ী মালিকরা অবশ্য সরকারের অংশীদার। বেসরকারী খাতের সবচেয়ে বেসিক চাকরি আইটি খাতের। জ্ঞান অর্থনীতির খাত নাকি ওটা। ওখানে তো চাকরি যায় সকাল-বিকাল। তারা এখন চাকরিচ্যুতির জন্য কমপেনসশনের দাবিতে আন্দোলন করে। বিশ্ব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আছে কয়েকটি। সেখানেও চাকরির নিরাপত্তা নেইÑ কারণ তারা বেসরকারী খাতের প্রতিষ্ঠান। বেসরকারী খাতে এখন লোক ‘ভাড়া’ করা হয়। চাকরি দেয়া হয় না নিচু স্তরে। বেসরকারী খাত হরদম বলে ‘মেরিট আর পারফরম্যান্সের’ কথা। অথচ এর মালিকরা কোন মেধার বলে হাজার কোটির মালিক হলেন তার হিসাব কেউ দেয় না। তুলনা কত করব। যারাই ভুক্তভোগী তারাই তা জানেন। দিন দিন দুই খাতের মধ্যে সরকারী খাতের গুরুত্ব বাড়ছে। বেসরকারী খাতের চাকরি মানেই এখন অনিশ্চয়তা, মধ্য বয়সে চাকরিচ্যুতি, ছেলেমেয়ে নিয়ে রাস্তায়। অথচ দেশে এমন ব্যবস্থা নেই যে, সরকার খাওয়াবে-পরাবে। তাহলে উপায়? সরকারী চাকরি তো অফুরন্ত নয়। দেশের সব শিক্ষিত ছেলেমেয়েকে সরকারী খাতে চাকরি দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে কী সঞ্চয় ভাঙ্গিয়ে চলতে হবে? না, তার সুযোগ দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে ব্যাংক সুদ দেয় না। তবে রক্ষা তারা এখনও টাকা রাখার জন্য উল্টো সার্ভিস চার্জ ধার্য করে না। ভবিষ্যতে করতেও পারে। তবে কী সঞ্চয়পত্র? এটাও তুলে দেয়ার আয়োজন চারদিকে। কিসের সঞ্চয়? আমরা আমেরিকার অনুসারী তাদের কোন সঞ্চয় নেই। তারা সবাই ধনী। তাদের রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে দেখে। অতএব সঞ্চয়ের দরকার নেই। তবে শুনেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নাকি সঞ্চয়পত্র প্রকল্পটি টিকে আছে। তা না হলে কবে এর বারোটা বাজানো হতো। এমতাবস্থায় কী শেয়ারবাজারে যাবে লোকজন? সেখানে যে কা- আবার এখন ঘটছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। কোম্পানির মিটিং হয় না। কোম্পানি লভ্যাংশ দেয় না, কোম্পানির মালিকদের কোম্পানিতে কোন শেয়ার নেইÑ অথচ ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ। ‘জাঙ্ক’ কোম্পানি। অথচ তার শেয়ারের দাম আকাশে এক মাত্র ঈশ্বর জানেন কারা কী করছে। একজন বলল একমাত্র ভরসা ব্যবসা-ছোট ছোট ব্যবসা বড় শিল্প নয়। ওটা তো শত শত কোটি টাকার মামলা। কোত্থেকে আসবে টাকা পুঁজি। অতএব ছোট ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। হয়ত তা সম্ভব। একেই নাকি বলা হচ্ছে ‘স্টার্টআপ’। ‘স্টার্টআপ’ মানে কী নতুন ব্যবসা, নতুন উদ্যোগ? যদি তা হয় তাহলে ঠিকই আছে। আর যদি এর অর্থ হয় অনেক টাকার ‘হাইটেক’ ব্যবসা তাহলে তো বিপদ। কতজন ‘হাইটেক’ ব্যবসা বুঝবে? কাগজে দেখলাম দেশে ‘এঞ্জেল’ নামে একটা নতুন বিনিয়োগকারীর গ্রুপ আছে। ‘এঞ্জেল’ মানে কী দেবতা? জানি না কী অর্থে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। জানা যাচ্ছে এরা ধনাঢ্য ব্যক্তি, প্রভাবশালী বক্তি। তাদের টাকা আছে। তারা নতুন নতুন ব্যবসা উদ্যোগে পুঁজি সরবরাহ করে। কী কী নতুন উদ্যোগ? কাগজে দেখলাম তারা ইন্টারনেটে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় টাকা দেয়। ই-কমার্সে টাকা দেয়, মোবাইল ব্যবসায় টাকা দেয়। দেয় মানে কিছু কিছু দিয়েছে। কিন্তু সেসব বড় টাকার ব্যবসা। দুই- চার- পাঁচ-দশ-বিশ লাখ টাকার ব্যবসায় কী তারা আছে? অথচ চাকরি সংস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই দরকার। শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এত টাকা কোথায় পাবে যে সে চাকরি না খুঁজে ব্যবসায় নামবে। অল্প টাকায় কিছু একটা করা এখন অসম্ভব ব্যাপার। ঢাকার যে কোন ব্যবসা অঞ্চলে কোন একটা ‘শপ’ দোকান, অফিস নিতে কত টাকা লাগে। সেলামি ভিত্তিতে কত লাগে? ক্রয়ভিত্তিতে কত লাগে। যারা একটু খবর রাখেন তারাই জানেন দশ-বিশ-ত্রিশ লাখ টাকায় এখন কোন ছোট ব্যবসা করাও সম্ভব নয়। ‘স্টার্ট আপ’ বলতে যদি ছোট ব্যবসাকে যুক্ত করা হয় তাহলে প্রশ্ন ‘স্টার্ট আপের’ পুঁজি কে জোগাবে? বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন? প্রশ্নই উঠে না। আমাদের মধ্যবিত্তের সিংহ ভাগেরই এই পরিমাণ টাকা নেই। যাদের আছে তাদের টাকা- পয়সা দেশে নেই। তাহলে ‘স্টার্ট আপ’-এর ভবিষ্যত কী? চাকরিও পাওয়া যাবে না। সঞ্চয়ও নেই, ব্যাংকও কোন সুদ দেয় না। শেয়ারবাজারে যাওয়া যাবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ‘স্টার্ট আপ’ও হবে না। যে ‘স্টার্ট আপ’-এর কথা বলা হচ্ছে তা হাইটেক, হাইমানির ব্যাপার। এটা তো সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। অতএব চাকরি খোঁজ, সরকারী চাকরি, যেভাবে পারা যায়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×