ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিজওয়ান সৈয়দ জামিল আহমেদের ম্যাজিক

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রিজওয়ান সৈয়দ জামিল আহমেদের ম্যাজিক

মঞ্চ যেন আবার ফিরে পেল তার প্রান। ঈদের ছুটিতেও উৎসবমুখর পরিবেশে আলোকিত হলো জাতীয় নাট্যশালা। এ যেন আশির দশকের ঈদে সিনেমা হলগুলোর প্রতিচ্ছবি। কাউন্টারে ভিড়, অনেকে টিকেট না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে প্রস্থান, কেউবা পরের দিনের টিকেট সংগ্রহে ব্যস্ত। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয় এ যেন সত্যি এক ম্যাজিক। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় নাটক মানেই একটি ভিন্নমাত্রার প্রযোজনা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই থাকবে নতুনত্বের ছাপ। মঞ্চ সজ্জা, আলোকসজ্জায় থাকবে অকল্পনীয় মেধার পরিস্ফুটন। নাটকের নাম রিজওয়ান। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি আগা শহীদ আলীর ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস’ কবিতা অবলম্বনে এর নাট্যরূপ দেন অভিষেক মজুমদার যা পরবর্তীতে ঋদ্বিবেশ ভট্টাচার্যের অনুবাদে বাংলায় অনূদিত হয় নাটক রিজওয়ান। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরের ওপর ভারতের জারি করা আইনের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদ করলে সেখানে চালানো হয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, পুড়ে ফেলা হয় ঘরবাড়ি, ধর্ষণ করা হয় মেয়েদের। সাত মাস কোন চিঠিপত্রও পৌঁছায়নি কাশ্মীরে। গল্পের মূল কাহিনী এই। কিন্তু এর চেয়েও বড় সত্য গণহত্যাবিরোধী এই নাটক আজ সারা বিশ্বে বর্তমান। এ যেন আমাদের জীবনের গল্প। সৈয়দ জামিল আহমেদ যেন এ সময়ের ঘটনাগুলোই তার নিপুণ কৌশলে মালা গেঁথে সাজিয়ে দিয়েছেন জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। আর সে সঙ্গে পরীক্ষণ থিয়েটার যেন আজ সার্থক হয়েছে। রিসোর্স শুধু থাকলেই চলবে না, তার যথাযথ ব্যবহার করার দক্ষতাও প্রয়োজন। এই মঞ্চকে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ যেভাবে ব্যবহার করেছেন হয়ত অন্য মঞ্চ হলে তা কষ্টসাধ্য ছিল। তাই বলতে চাই এটি আমাদের দেশের একটি বড় সম্পদ যা জামিল আহমেদের হাতে পড়ে এর ভিন্ন মাত্রিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এ থেকে যেন পরবর্তী নাট্য কলাকুশলীরা এই মঞ্চটাকে আরও ভালভাবে ব্যবহার করতে পারেন। ‘রিজওয়ান’ নামক এই নিরীক্ষা বাংলা নাট্যকে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। আলোক সম্পাতের এত নিপুণ খেলা আর ভিন্ন ভিন্ন আবহ সৃষ্টি যেন নাটকের মূল গল্পে দর্শককে বিচরণ করায়। দর্শকের মস্তিষ্কে ঝড় সৃষ্টি হয়।মনে হয় রিজওয়ান, ফাতেমার গল্পের কুন্ডলিতে ঘুরপ্াক খাচ্ছি । চোখের সামনে ভেসে ওঠে দৈনিক কাগজের প্রকাশিত নিষ্পেষিত মানুষের সেই সংবাদগুলো, ভেসে ওঠে তনু, রুপার মুখ। রিজওয়ান নাটক যেন একেবারে আমাদের জীবনের কথা বলে। এবার আসি কুশীলবদের কাছে। নাটকের পুরো অংশে রয়েছে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের নিবেদনের ছাপ। কতটা পরিশ্রম আর একাগ্রতা এর পেছনে রয়েছে তা নাট্যকলার ছাত্র হিসেবে বেশ অনুমান করতে পারছি। গত দুই মাসব্যাপী এই কুশীলবদের শরীর ও মাথায় অন্য চিন্তা বা কর্ম কোনটাই যে স্থান পায়নি তার সুস্পষ্ট ছাপ তারা এই নাটকে রেখেছেন। রিজওয়ানকে হত্যা করার পর তার নিথর দেহ যেভাবে দোতলা থেকে নিচে পড়ে গেল এরপর সেই অভিনেতাকে অভিনয় বা পরিশ্রমের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা অনভিপ্রেত। আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এতটাই শক্ত না হলে এ দৃশ্য অসম্ভব। ফাতেমা ও তার মা সহ সকল কুশলীর ছিল সেই মাত্রার অভিনয় যা সৈয়দ জামিল আহমেদের নাটক দাবি করে। সর্বোপরি নাটকের বার্তা যথাযথভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছেছে তবে অনূবাদে কিছুটা দূর্বলতা লক্ষ্যনীয় যা সংলাপের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে নাটবাঙলা আয়োজন করেছে ১০ দিনব্যাপী নাট্যোৎসব। ১ সেপ্টেম্বর হতে ১০ সেপ্টেম্বর প্রতিদিন বিকেল ৪টায়ও রাত ৮টায় দুটি করে পরিবেশনা হয় যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য। আর সেই শারীরিক- মানসিক সক্ষমতা সৃষ্টির নেপথ্যে নির্মাতার কৌশলও কুশীলবদের পরিশ্রম যেন এক সূত্রে গাঁথা। দীর্ঘ বিরতির পর ঢাকার মঞ্চ আবার সৈয়দ জামিল আহমেদের বদৌলতে দর্শকমুখর হয়ে উঠার পাশাপাশি ঈদের ছুটিতেও নিরব শিল্পকলা যে সরব হতে পারে তার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদই প্রথম বাংলা নাটককে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে মঞ্চায়িত করেন। সেলিম আলদীনের রচিত ‘চাকা’ নাটকটি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করে ডেনি প্যাট্রেজের সঙ্গে যৌথভাবে নির্দেশনা দেন আমেরিকায় যা তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে। এ ছাড়া ২০১০ সালে এনএস ডি তে তিনি ম্যাকবেথ ও ২০১২ সালে কলকাতায় ‘শ্যামার উড়াল’ নাটকের নির্দেশনা দেন। সর্বোপরি বলতে হয় নাটক যদি তার গুণগত মান ধরে রাখতে পারে, দর্শক তা গ্রহণ করবেই। তাই নাটক অবশ্যই মানসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয় নতুবা এই শিল্পও হুমকির সম্মুখীন হবে।
×