ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান ;###;আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির তাগিদ;###;শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণ

উখিয়ায় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ॥ রোহিঙ্গাদের পাশে আছি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

উখিয়ায় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ॥ রোহিঙ্গাদের পাশে আছি

চট্টগ্রাম অফিস/কক্সবাজার প্রতিনিধি ॥ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমরা সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই, নির্যাতন বন্ধ করুন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন।’ আর রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘যতদিন তারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে না ততদিন বাংলাদেশ তাদের পাশে থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও কোন ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশ্ত করা হবে না। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসে সেখান থেকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রিত ও শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়। উপায়ন্তর না দেখে এ দেশের মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি ত্রাণ সাহায্য ও চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তিনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনসাধারণের উপস্থিতিতে এ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছেÑ তাতে কি তাদের বিবেক নাড়া দেয় না। কারও ভুলে এভাবে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারা হতে পারে না। আমরা শান্তি চাই। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সেখানে সাধারণ নিরীহ মানুষের সকল ধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন এ অত্যাচার? রোহিঙ্গারা তো মিয়ানমারেরই নাগরিক। ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। সেখানে এখনও চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বহু মানুষ আপনজনদের হদিস পাচ্ছে না। নাফ নদে শিশু-নারীর লাশ। এ ধরনের ঘটনা অমানবিক, মানবাধিকারের লঙ্ঘন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারে কোন ঘটনা ঘটলে এর চাপ এ দেশে পড়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাকালে সমাবেশে উপস্থিত জনতার মাঝে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত সকলের মাঝে ভিন্ন আবহের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, মানবতার খাতিরে দুস্থ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ তারা এক বস্ত্রে ঘরবাড়ি ছেড়ে এ দেশে পালিয়ে এসেছে। সঙ্গে কিছুই আনতে পারেনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যে যা ঘটেছে তা মানবতাবিরোধী। একদিকে সারি সারি লাশ, অপরদিকে লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গার আশ্রয়। দেশী-বিদেশী সকল সংস্থা ও সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, সরেজমিনে এসে আপনারা রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে যান। তাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা শুনুন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। মিয়ানমার সরকারকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি তাদের বলব সেখানে যেন নিরীহ মানুষের ওপর আর কোন নির্যাতন-নিপীড়ন করা না হয়। এ নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। তাদের কাছে যারা প্রকৃত দোষী তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিন। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যে সহযোগিতা দরকার বাংলাদেশ তা করবে। বাংলাদেশ কখনই সন্ত্রাসী কার্যক্রম মেনে নেবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু তাতে তারা সাড়া দেয়নি। এমনকি রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবেও মেনে নিতে রাজি নয়। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর কূটনেতিক চাপ সৃষ্টির একটি প্রস্তাব সংসদে সোমবার সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। সুতরাং রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে ব্যবস্থা মিয়ানমারকেই করতে হবে। তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ যেন করা না হয়। মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইন পরিবর্তন করে কেন এ ঘটনা সৃষ্টি করা হলো। এ ঘটনা না ঘটলে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করা হতো না। এখন ভুক্তভোগী হয়েছে নিরীহ রোহিঙ্গা। তাদের যেভাবে ওপর নির্বিচারে অত্যাচার করা হয়েছে তা সহ্য করা যায় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন কেন এ বর্বর আচরণ। তারা তো সে দেশেরই লোক। রাখাইন রাজ্যে বর্ডার পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের চৌকিতে হামলার ঘটনায় যারা দায়ী তাদের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে অসহায় রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার কেন শুরু হলো। মিয়ানমার সরকারকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করুন। বাংলাদেশ কোন সন্ত্রাসী কর্মকা-কে প্রশ্রয় দেবে না। তিনি মিয়ানমারের দুই পক্ষকে মানবিক আচরণ দেখাতে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা আরও বলেন, যাদের জন্য এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তারা নিজেরা দেখুক তাদের মা-বোন ও শিশুদের ওপর কি অমানবিক নির্যাতন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। প্রশ্ন রাখেন, কাদের অপকর্মের জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গা আজ ঘরছাড়া। বক্তৃতা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার বার বার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে শান্তি চায়, সুসম্পর্ক চায়। কিন্তু অন্যায়কে বরদাশ্ত করা যায় না। তিনি কক্সবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যারা আশ্রয়ের জন্য এসেছে তাদের যেন কোন কষ্ট না নয়। সুযোগ নিয়ে যাতে কেউ নিজেদের ভাগ্য গড়ার খেলা খেলতে না পারে সে জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি। তার ওপর রোহিঙ্গাদের স্থান দেয়া অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তিনি মিয়ানমারের প্রতি আবারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ওরা সে দেশের নাগরিক। তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। নিরাপত্তা দিতে হবে। নিজেদের নাগরিক অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া সম্মানজনক নয়। তিনি কক্সবাজারের স্থানীয়দের প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। বেসরকারী পর্যায়ে যারা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে চায় তাদের সরকারী রিলিফ কমিটির মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদানের আহ্বানও জানান। জনসভায় বক্তব্য রাখার আগে প্রধানমন্ত্রী তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে উখিয়ায় শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তিনি হতভাগ্য রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের অনেককে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাদের ওপর নির্যাতনের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। পরে তিনি তাদের মাঝে কিছু ত্রাণ সাহায্য বিতরণ করেন। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার পুত্র ববির পুত্র পেপি সিদ্দিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, হুইপ ইকবালুর রহিম, কক্সবাজারের এমপি সাইমুম সরোয়ার কমল, লোহাগাড়া সাতকানিয়ার এমপি আবু রেজা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন নদভী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব সফিউল আলম, মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান আবু বেলার মোহাম্মদ শফিউল হক, আইজি একেএম শহীদুল হক, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম, প্রেস সচিব ইহ্সানুল করিম। প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক ॥ উখিয়ায় সমাবেশ শেষে বিকেলে প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সার্কিট হাউসে প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানানো হয়। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিয়েছেন, দেশী-বিদেশী কোন ত্রাণ নিয়ে যেন নয়-ছয় করা না হয়। এছাড়া আগে এবং সম্প্রতি আসা প্রতিটি রোহিঙ্গা সদস্য যেন নিবন্ধনের আওতায় আসে, সে জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনাও দেন। প্রধানমন্ত্রী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেন কোন বাণিজ্য না হয়। এছাড়া রোহিঙ্গারা যাতে ইতোমধ্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া এলাকায় বসবাস করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ধাপে ধাপে নিশ্চিত করারও নির্দেশনা দেন।
×