ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ॥ স্রোতের আড়ালে

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ॥ স্রোতের আড়ালে

দু’দিন আগেও ডোকলাম সীমান্ত নিয়ে চীন-ভারত মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। অথচ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে এখন তাদের অবস্থান প্রায় অভিন্ন। চীনের স্বার্থপরতার সঙ্গে বাংলাদেশের পূর্ব পরিচয় আছে। ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নিরীহ নারী-পুরুষের ওপর নাৎসি স্টাইলে বর্বরতা চালাচ্ছে চীন তখন সেই ইয়াহিয়াকে আত্মীয়-পরিজনসহ নিজ দেশে লালগালিচা সংবর্র্ধনা দিয়ে আপ্যায়ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তখন তাদের মাখোমাখো সম্পর্ক। যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসময় ছিল চরম শত্রুতা, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পর সেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই হয়েছিল গভীর সখ্য। চীনের এ স্বার্থপরতা ইতিহাসবিদিত। কিন্তু বাংলাদেশের ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ হিসেবে ভারতের নীরবতা অনেকের মনে বিস্ময় জাগিয়েছে। ভারতের কণ্ঠ এত ক্ষীণ কেন? বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্র বার বার বলছে ভারতের কাছ থেকে যতটা জোরালো অবস্থান আশা করা হচ্ছে তার সামান্যটুকুও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কারণটা স্পষ্ট হয় ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্যের বক্তব্যে। সোমবার বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, ভারতের অবস্থাটা আসলে জটিল। তার একদিকে বাংলাদেশ অন্যদিকে মিয়ানমার। দু’দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ভাল। দুই দেশকেই তার দরকার। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নটি এমন এক ইস্যু যা নিয়ে দু’দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা ভারতের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তো আছেই, মিয়ানমারে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারতের মরিয়া প্রচেষ্টা। জয়িতা ভট্টাচার্য খোলাখুলিই বলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলব, মিয়ানমারে ভারত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। ফলে মিয়ানমারকে তারা কোনভাবেই বিরক্ত করতে চাইবে না, আবার বাংলাদেশের স্বার্থও তাদের দেখতে হবে’। জটিলতা এখানেই। ‘একুশ শতক হবে এশিয়া’রÑ বিশেষজ্ঞ মহল থেকে এই যে কথাটা বলা হচ্ছে তার প্রাণ ভোমরার একটি অংশ রয়েছে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার এই বেল্টে। নীরবে সাম্রাজ্য বিস্তারকারী চীন এ কথা বুঝেছিল বহু আগে। আরাকান উপসাগরীয় অঞ্চলে যে প্রচুর তেল-গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে চীন তাতে বিনিয়োগ করেছে। দু’হাজার চার সালে আরাকানের গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রে পাইপ লাইন বসিয়ে ইউনাইন রাজ্যের কুনমিংয়ে গ্যাস নিচ্ছে চীন। আরাকানে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরও নির্মাণ করেছে তারা। যা সড়কপথে কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে তাদের অর্ধেক সময় লাগবে। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের মূল্যও কম হবে। এসব তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান’ এবং ‘স্প্রিং অব পার্ল’ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্ব জোড়া সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর চীন এত সব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেবে এমন ভাবা সম্ভবত দুরাশা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদিও কিছু বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছে তবে তা কেবলই বাক সর্বস্ব। গলায় তেমন জোর নেই। কারণ এ অঞ্চলের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি রয়েছে তাদেরও। এসব ব্যবসায়িক স্বার্থের পাশাপাশি অন্য এক কূটকৌশলের ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘টাইম’ ম্যাগাজিন সূত্রে। দু’হাজার চৌদ্দর পহেলা জুলাই সংখ্যায় ‘টাইম ম্যাগাজিন’ তাদের প্রচ্ছদ শিরোনাম করেছিল ‘দ্য ফেস অব বুদ্ধিস্ট টেরর।’ এতে অশিন ভিরাথু নামে মিয়ানমারের এক চরমপন্থী বৌদ্ধ ধর্মগুরুকে তুলে ধরেছিল তারা। তার আগে শ্রীলঙ্কার চরমপন্থী বৌদ্ধ গ্রুপ বোড়ুবালা সেনার (ইধফঁ নধষধ ংবহধ) নেতা গালাগোদাত্থে নানাসারা (এধষধমড়ফধঃযঃযব এহধহধংৎধ) এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বৌদ্ধদের আন্তর্জাতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে।’ অশিন ভিরাথু ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, নানাসারা ভারতীয় ডানপন্থী হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘হিন্দু বৌদ্ধ শান্তি এলাকা’ গঠনে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস’ ষোলো অক্টোবর দু’হাজার চৌদ্দ সংখ্যার সম্পাদকীয় কলামে লিখেছে, ‘দালাইলামা মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মীয় চরমপন্থী গ্রুপগুলোর প্রতি মুসলমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক আচরণ বন্ধ করার আহ্বান জানান। এ ধরনের উস্কানির ফলে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। জুলাই মাসে দালাইলামা তার ঊনআশিতম জন্মদিনে এ আহ্বান করেছিলেন, কিন্তু এতে তারা সাড়া না দিয়ে সাধারণ জোট গঠনের ঘোষণা দেন।’ ধর্ম নিয়ে কলকাঠি নাড়ার পুরনো কৌশলের পাশাপাশি হয়ত নতুন চাল সংযোজন হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে নিরীহ জনগণের ওপর নিপীড়ন হিসেবে না দেখে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে তোলার চেষ্টাটাও বেশ লক্ষ্যণীয়। প্রতিবাদটা তাই মূলতঃ কিছু মুসলিম দেশ থেকেই আসছে। তবে মুসলিম দুনিয়ার ‘অভিভাবক’ সৌদি আরব কিন্তু এখন চুপ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে ধর্ম সব সময়ই প্রিয়। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর এখন যদিও প্রতিপক্ষ কেউ নেই। এখন যা হচ্ছে তা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও তা ধরে রাখার কৌশলের খেলা। যুদ্ধ অবস্থার টান টান উত্তেজনা বজায় রাখতে হয় অস্ত্র ব্যবসার মুনাফাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার জন্য। নিজের নিরাপত্তার জন্য সামরিক খাতে নিরন্তর ব্যয় বাড়িয়ে চলা আর বিভিন্ন দেশে সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চড়া দামে অস্ত্র বিক্রি করা। ইসলামী জঙ্গীবাদের নামে অস্ত্রবাণিজ্যের প্রথম সফল প্রকল্পের নাম ‘আল কায়দা।’ ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে সংগঠনটি জলে-তেলে নাদুস-নুদুস হয়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদার সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতায়। তারপর সব পানি গড়িয়েছে বিশ্ববাসীর সামনেই। হারাবার যাদের তারা সব হারিয়েছে। বিন লাদেনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আল কায়দারও ভাত নেই। আইএস-এর পরিণতি কি তা এখনও পরিস্কার নয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সম্ভবত চলছে নতুনরূপে সন্ত্রাসের পরিবর্ধিত সংস্করণের কাজ। পাকিস্তান তো ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের পীঠস্থান হয়েই আছে। আল কায়দা-তালেবানের পর লস্কর-ই তৈয়েবা ও নানান নামের অসংখ্য জঙ্গী গ্রুপ সে দেশের শোভা বর্ধন করছে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী আশির দশক থেকে সন্ত্রাসের যে ধারা তৈরি করেছে তার অনুকূল স্রোতে বেড়ে উঠেছে আরও অসংখ্য সন্ত্রাসী গ্রুপ। ভারতে জনসংখ্যার শতকরা তেরো ভাগ মুসলমান। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকে। মুম্বাই ও দিল্লীতে সফল অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। বর্ধমানে বোমা ফাটাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার কারণ ছিল না। এটা ওই পরিবর্ধিত সংস্করণের কৌশল। প্রচার মাধ্যম জানিয়েছে ওই সন্ত্রাসীদের মূল ঘাঁটি বাংলাদেশ, এটি শুধু একটি তথ্যমাত্র নয়। ইসলামী জঙ্গী গ্রুপ দিয়ে মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত। হাতের পাঁচ হিসেবে এখন গড়ে তোলা হচ্ছে ‘হিন্দু-বৌদ্ধ শান্তি এলাকা’। বিশ্বের ক্ষমতাশীল দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনে সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ছে। অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে পরিপুষ্ট করছে এবং সবচেয়ে ভয়াবহ হলো এই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টার ইন্টার প্রোটেশন এমনভাবে হয় যে, সাধারণ মানুষ এর সঙ্গে ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে ফেলে। রোহিঙ্গা বিষয়ক চাল বা খেলার আসল উৎস পরিস্কার হতে সম্ভবত আরও খানিকটা সময় লাগবে।
×