ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিক ফিরিয়ে নিতে হবে

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিক ফিরিয়ে নিতে হবে

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা মানবিক কারণে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় প্রদানের কথা তুলে ধরে বলেছেন, কে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান তা আমরা দেখিনি, আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি এবং মানবিক কারণেই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছি। আমরা তো অমানুষ ও অমানবিক হতে পারি না বলেই সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তবে মিয়ানমার সরকার এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে, সমাধানও তাদেরই করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারি। অবশ্যই বাংলাদেশে আসা তাদের প্রত্যেক নাগরিককে মিয়ানমার সরকারকে ফেরত নিতে হবে। প্রয়োজনে মিয়ানমারে সেফ জোন সৃষ্টি করে তাদের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এদেশে আসা রোহিঙ্গারা তাদের দেশেরই নাগরিক। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দুর্ভোগের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ যেন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা না করে। আবার কেউ যেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়া বা ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার চেষ্টা না করে। সাহায্য বা সহযোগিতা না করে কেউ বড় বড় স্টেটমেন্ট দেবেন, সেটি হবে না। আমরা দেশের ১৬ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। আর এই ৪/৫ লাখ লোকের মুখে খাবার তুলে দেয়ার ক্ষমতাও আমাদের রয়েছে। সত্যিকার যারা এসেছে তাদের আইডেনটিটি থাকবে, ছবি থাকবে। সাময়িকভাবে তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা সাময়িক ব্যবস্থা। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এই ইস্যুটি জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে জোরালোভাবে তুলে ধরার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সোমবার সংসদ অধিবেশনে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি কর্তৃক রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ (১) বিধি অনুসারে আনীত প্রস্তাবটি (সাধারণ) সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সন্ধ্যা সোয়া সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার সাধারণ আলোচনায় সরকার ও বিরোধী দলের মোট ১৬ জন বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হলে স্পীকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। ১৯৫৪ সালেই মিয়ানমারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাসহ দেশটির সকল ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে সমান অধিকার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে এখন তাদের দেশ থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। গোটা বিশ্ব বিবেকের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এ ঘটনা। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে গত কয়েক দিনে কয়েক লাখ মানুষ এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। অত্যাচারের যে চিত্র দেখলাম তা বলার ভাষা খুুঁজে পাচ্ছি না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। এটা তো সবাই জানে। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের মিলিটারি জান্তা তাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ’৮১ ও ’৮২ সালে তারা যে আইন করে সেখানে চার স্তর বিশিষ্ট সিটিজেনশিপ চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের অধিকার কেড়ে নেয়া। একটা জাতির ওপর মিয়ানমার সরকার এ ধরনের আচরণ কেন করছে তা জানি না। আমরা বারবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রতিবাদ করছি। আমি যে ক’বার মিয়ানমার সফর করেছি তাদের বলেছি আপনারা আপনাদের নাগরিক আমাদের দেশ থেকে ফিরিয়ে নিন। ফিরিয়ে নেয়া তো দূরের কথা। তারা উল্টো তাদের ওপর অত্যাচার চালাতে লাগল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১২ সালে ও ২০১৬ সালে দুষ্কৃতকারীরা তাদের পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এর জেরে সাধারণ মানুষদের ওপর অত্যাচার চালানো শুরু করে। শিশুর লাশ নাফ নদীতে ভাসছে। গুলি খাওয়া মানুষ আছে। মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। আমরা তো মানুষ। তাদের আশ্রয়ে নিষেধ করব কিভাবে? আমাদের তো অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানীরা যে ঘটনা ঘটিয়েছিল সেসব চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আমরা তো ভুক্তভোগী ছিলাম। আমিও তো ৬ বছর ধরে রিফিউজি হয়ে ছিলাম। রিফিউজি হয়ে থাকার কষ্ট আমরা জানি। তাই এদের আশ্রয় দিয়েছি মানবিক কারণে, অন্য কোন কারণে নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক দেশের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চাই। মিয়ানমার সরকারকে বলতে চাই, রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া, হঠাৎ রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার ফলাফল কি হতে পারে সেটা কি তারা চিন্তা করছে। তিনি বলেন, আমরা কখনই এ ধরনের কর্মকা-কে সমর্থন করব না। উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিবেশ ছিল। এই অশান্ত পরিবেশ মোকাবেলা করতে সামরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হতো। ’৮১ সালে দেশে এসে ঘোষণা দিয়েছিলোম এটা সামরিকভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। পরে সরকারে এসে আমরা শান্তিচুক্তি করি। ভারতে থাকা আমাদের সকল নাগরিককে ফেরত এনে তাদের পুনর্বাসন করি। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নাগরিক অন্য দেশে রিফিউজি হয়ে থাকবে এটা মোটেই দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। মিয়ানমার সরকারকে এটা আমরা বার বার বলেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর হামলা-নির্যাতনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা দেখতে পাই। সমস্ত মুসলিম উম্মাহ যদি এটা অনুভব করত বা ঐক্যবদ্ধ থাকত তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। তিনি বলেন, আউং সান সুচি নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন। মিয়ানমারে কেবল গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু আইন করে সুচিকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে সেখানে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি বেশি। এখানে আউং সান সুচিরই বা ক্ষমতা কতটুকু সেটাও ভেবে দেখা দরকার। তিনি বলেন, মিয়ানমারের এক জেনারেল ঘোষণা দিয়েছেন এরা সব বাঙালী। বাঙালী তো পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। আর বাঙালী বলেই কি এভাবে নির্যাতন করবে, তাড়িয়ে দেবে? তারা তো বছরের পর বছর সেখানে বাস করছে। বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে প্রতিবেশী দেশে কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করতে না দিতে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা (দেশটির সন্ত্রাসী গোষ্ঠী) মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে তারা কি অর্জন করছে? তারা এটা কি বোঝে না তাদের কারণে আজ লাখ লাখ মানুষের ওপর পাশবিক অত্যাচার হচ্ছে। এ অবস্থা কেন তারা সৃষ্টি করে দিচ্ছে? যারা তাদের অস্ত্র জোগান দিচ্ছে হয়ত তারা লাভবান হচ্ছে। তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে আজ মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক কষ্ট পাচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে। আমি বলেছি, প্রয়োজনে সন্ত্রাসীদের ধরতে যৌথভাবে কাজ করতে পারি। তবে গুটিকয়েক সন্ত্রাসীর কারণে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন কেন? শিশু-নারীরা কি অপরাধ করেছে? এটা আমরা মানতে পারি না, মানতে চাই না। যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের প্রত্যেককে ফিরিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে সেফ জোন করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাখাইন রাজ্য থেকে যাদের বিতাড়ন করা হয়েছে তাদেরও ফেরত নিতে হবে। আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। এই সমস্যা মিয়ানমার সৃষ্টি করেছে এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে।
×