ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আরসা’ নিয়ে কিছু তথ্য-

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘আরসা’ নিয়ে কিছু তথ্য-

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সংগঠন জন্ম নিয়েছে। সর্বশেষ যে সংগঠনটি আলোচনার পাদপীঠে রয়েছে এর নাম আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি)। মিয়ানমার সরকার সংগঠনটিকে সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে বলে দাবি করে আসছে। কিন্তু আরসার পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যে ঘোষণা এসেছে তাতে রয়েছেÑতারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, স্বাধীনতাকামীও নয়; মূলত তারা, তাদের সংগ্রাম সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নিজেদের নাগরিকত্বসহ সকল প্রকার অধিকার আদায় নিয়ে। আরসা নামটি সাম্প্রতিকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে বর্তমানে আরসার প্রধান হিসেবে যার নাম রয়েছে তিনি হচ্ছেন আতউল্লাহ আবু আমর জুনুনি। আতাউল্লাহর পিতা পাকিস্তান আমলে রাখাইন রাজ্য থেকে করাচীতে চলে যান। করাচীতেই আতাউল্লাহর জন্ম। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন সৌদি আরবের মক্কায়। মাদ্রাসায় লেখাপড়া শিক্ষিত। রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষা ছাড়াও আরবী এবং উর্দুতেও কথা বলতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভিডিও টেপ ছাড়া হয় তাতে তিনি রোহিঙ্গাদের ভাষায় বক্তব্য দেন, যা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে মিল রয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি- এ আরসার পক্ষ থেকে গত ২৪ আগস্ট সেখানকার ৩৪টি সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলা চালানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরেও অনুরূপ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এই আরসা। মিয়ানমার আরসা সদস্যদের দমনে মাঠে নেমেছে বলে দাবি করলেও প্রকারান্তরে তাদের অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িতই করা হচ্ছে। এ অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হচ্ছে; যা গণহত্যার শামিল। ইতোমধ্যে বিশ্ব অঙ্গনে রাখাইন রাজ্যের ঘটনাকে নিরীহ রোহিঙ্গা গণহত্যা হিসেবে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি মিলেছে। আবার বিভিন্ন সংস্থা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। বিভিন্নভাবে জানা গেছে, আরসা মূলত ফেইথ মুভমেন্ট নামে ইতোপূর্বে তাদের তৎপরতা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যে এটি ‘হারকাহ আল ইয়াকিন’ নামে পরিচিত। এদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি লাভ করেছে, বিভিন্নভাবে এরা প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণায় বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস ব্যুরো তাদের রিপোর্টে বলেছে, আরসা সংগঠনটি মূলত সংগঠিত হয়েছে সৌদি আরবের মক্কায়। সেখানে আগে থেকে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা সদস্যদের একটি গ্রুপ মিলে এ সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে আরসা নেতা আতাউল্লাহ সৌদি আরব থেকে আত্মগোপন করেন। ধারণা করা হচ্ছে, আতাউল্লাহ তার দলবল নিয়ে আরাকান রাজ্যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এরপর থেকেই কয়েক দফায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরা আরাকানের গহিন রাজ্যে ঘাঁটি গেড়েছে বলেও প্রচার রয়েছে। সংগঠনটির পক্ষে গত মার্চ মাসে পরিষ্কারভাবে বলেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় তারা কাজ করছে। তাদের মূল টার্গেট মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী। নিজেদের আত্মরক্ষার্থেই তাদের এ তৎপরতা। তাদের মূল দাবি হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব্ এবং সেখানকার নাগরিকদের সমান মর্যাদা দিতে হবে। ওই বিবৃতিতে তাদের যে বক্তব্য রয়েছে তাতে দেখা যায়, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোন কর্মকা- চালায় না। তারা সন্ত্রাসবাদেও বিশ্বাসী নয়। শুধু তাই নয়, বিশ্বের কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি আরসার নীতি হচ্ছে রাখাইনে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষের ধর্মীয় উপাসনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মূলত গত অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে একটি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলার ঘটনার পর রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির কর্মকা- প্রচার মাধ্যমে চলে আসে। মিয়ানমার সরকারের দাবি, এ আরসাই গত ২৪ আগস্ট সেখানকার সেনা ও পুলিশ চৌকিতে হামলা চালিয়েছে। আরসাও এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে এতে আরসা সদস্যদের দমন করতে না পেরে অসহায় রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর হামলে পড়েছে জান্তা বাহিনী। কিন্তু মিয়ানমার সরকার বলে আসছে তারা আরসা তথা বাঙালী সন্ত্রাসী জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অথচ, এটা বাঙালী বা বাংলাদেশী কোন গোষ্ঠীর সংগঠন নয়। রাখাইনের রোহিঙ্গা সদস্যদেরই একটি সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এবং এ সংগঠনের প্রতি রোহিঙ্গাদের সমর্থনও রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে এ ধারণাও মিলেছে, আরসার পক্ষ থেকে বর্তমানে বিপুল যোদ্ধা এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে; যা দিয়ে তারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত। কিন্তু জান্তা বাহিনী যেভাবে নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে এবং দেশান্তর হতে বাধ্য করছে এ প্রেক্ষিতে তারা রবিবার থেকে একমাসের জন্য অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে। জানা গেছে, আরসার নেতৃত্বে রয়েছে ২০ রোহিঙ্গা নেতা। যার প্রধান আতাউল্লাহ আবু ওমর আল জুনুনি। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারি অস্ত্রে এবং অস্ত্রধারীদের পাহারায় আতাউল্লাহকে রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম নিয়ে বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে; যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেছে। রাখাইন রাজ্যকে বিদেশীদের বিনিয়োগ উপযোগী করার লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও রোহিঙ্গাদের ভয়ে ভীত। বিশেষ করে সামরিক জান্তা সুচি সরকারকে বাধ্য করছে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালাতে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মানÑ গণতন্ত্রমনা সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি বর্তমানে সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল হিসেবেই রয়েছেন। অন্যথায় একজন নোবেল বিজয়ীর পক্ষ থেকে গণহত্যাকে মেনে নেয়া যায় না বলে ইতোমধ্যে বহু নোবেল বিজয়ী বক্তব্য দিয়েছেন। এমন অভিযোগও করা হয়েছে, ক্ষমতার মোহে আউং সান সুচি এহেন ঘৃণ্য কর্মকা-কে সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন। তার পিতা অং সান যে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন সামরিক জান্তা সে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছেন। অবশ্য এ ঘটনা অং সানকে হত্যার পর। সুচি নিজেও দীর্ঘ সময় সামরিক জান্তার হাতে গৃহবন্দী ছিলেন। তার জন্য বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল। বাংলাদেশেও তার মুক্তির জন্য মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণও করা হয়েছে। অবশেষে তিনি মুক্তি পেয়েছেন এবং নির্বাচন করে সরকারও গঠন করেছিলেন। রোহিঙ্গারা তার প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। আশা করেছিল সুচি সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু প্রকারান্তরে হয়েছে উল্টো। আগে নাগরিকত্ব হারিয়েছে এখন প্রাণে মরছে। আর যারা বেঁচে আছে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহলে এ ঘটনা রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্তকরণ অভিযান হিসেবেই দেখছে। অবস্থাদৃষ্টে সেটিই প্রতীয়মান।
×