ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও তৃতীয় শক্তির উত্থান চেষ্টা, কী হবে এবার?

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আবারও তৃতীয় শক্তির উত্থান চেষ্টা, কী হবে এবার?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একজন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। অপরজন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। দু’জনেই দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ। যদিও এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোনটিতেই তারা নেই। দলছুট নেতা। দুটি পৃথক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা। আশানুরূপ কর্মী সমর্থক, সাংগঠনিক শক্তি বলতে কিছুই নেই। তবুও রাজনৈতিক দল। দীর্ঘ সময় এসব দলের বড় কোন কার্যক্রম না থাকলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক ঠিকই তৎপরতা দেখা যায়। চেষ্টা শুরু হয় তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি উত্থানের। বাস্তবতা হলো নতুন শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা দুই শীর্ষ নেতার মধ্যেই রয়েছে। বলা হচ্ছে ড. কামাল হোসেন ও ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কথা। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ফের নতুন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে তৎপর তারা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে নতুন জোট গঠনের প্রক্রিয়া অনেক দিন থেকেই চলছে। যদিও সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তাছাড়া যেসব সমমনা দলকে নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে যাত্রাপথেই তা হোঁচট খেয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন করে টানাপোড়েন। এর আগেই অন্তত চারবার কামাল হোসেন তৃতীয় শক্তি উত্থানের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। হাত মেলানোর পর সম্পর্কের মেয়াদ দুই মাসও স্থায়ী হয় না। ফের দেখা হয় নির্বাচনের আগে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৃতীয় ধারার শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি গঠন মোটেও সম্ভব নয়। তাছাড়া যেসব দলকে নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাদের কারও রাজনৈতিক শক্তি কর্মী-সমর্থক নেই। রয়েছে পরিচিত নেতার অভাব। তাই সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো অবস্থান কোন দলেরই নেই। নতুন জোটের নামে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চললেও তা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ২১ অক্টোবর এক মঞ্চে উঠে প্রথমবারের মতো জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন বি. চৌধুরী ও ড. কামাল। সে সময় আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী ও মান্নাসহ প্রগতিশীল অনেকেই সমর্থনও করেছিলেন। এরপর কাকরাইলের ঈশা খাঁ হোটেলে এক মতবিনিময় সভা ডেকে তৃতীয় ধারার পক্ষে সমমনা দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একত্রিত করার আবারও চেষ্টা চালান ড. কামাল। ওই সময় পাঁচটি দল ছাড়াও সিপিবি-বাসদ, জাতীয় পার্টি ও সুশীলসমাজের বেশ কিছু প্রতিনিধি সভায় যোগ দেন। তার আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্ট গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বি. চৌধুরী ও ড. কামাল। তখনও ব্যর্থ। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগেও এরকম তৃতীয় শক্তি উত্থানের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন ড. কামাল। এখন নতুন করে আবারও পাঁচ দলের সমন্বয়ে নতুন ঐক্য গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে গণফোরামের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমরা পাঁচ দল মিলে জোট গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তবে ফরমাল জোট গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমরা কাজের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সামনে হয়ত অন্য কোন দলও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তাই ধীরে ধীরে আমরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছি। সূত্রমতে, এবারের নতুন জোট গঠন প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক বৈঠক ও বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা লাইমলাইটে এসেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। আর সে কারণেই গত ২ আগস্ট রাতে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় বৈঠকের পর লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু বিষয়টি পছন্দ হয়নি গণফোরাম সভাপতি ড. কামালের। যে কারণে ২৪ আগস্ট আরেকটি উদ্যোগ নিয়ে এবং বি. চৌধুরীকে রাজি করিয়ে তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। আর এ ঘটনায় সম্ভাব্য জোটের দলগুলোর মধ্যে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। গণফোরামের নেতা সুব্রত চৌধুরী দাবি করেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কোন সমন্বয়ক করা হয়নি। তিনি বলেন, জোটই যেখানে গঠন হয়নি, সেখানে সমন্বয়ক কিভাবে এলো? তবে এটি ঠিক যে লেখালেখি বিষয়ে দেখভাল করার দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টা হলো, আমরা ভবিষ্যতে একটি জোট করব এবং জেলায় জেলায় যাব। এটুকু সমঝোতা হয়েছে যে আগে দুই নেতার একটি যৌথ বক্তব্য যাবে। সেটি কেন্দ্র করে দলগুলো সভা-সমাবেশ করবে। পাঁচ-ছয়টি দলের সম্ভাব্য জোটের মধ্যে শুধু দুই নেতার ঐক্যের ডাক সঙ্গত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা এই ডাক পছন্দ করবেন না, সেটি তাদের বিষয় কেউ যদি মনে করেন আমিও বি. চৌধুরী বা ড. কামাল হোসেনের পজিশনে যাব, তাহলে সেটি তার ব্যাপার। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা, ড. কামালের গণফোরাম, আ স ম রবের জেএসডি, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যসহ প্রগতিশীল আরও কয়েকটি দল নিয়ে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা বহুদিন ধরে চলছে। জোটের শরিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বি. চৌধুরীর বাসায় বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে একাধিক স্থানে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুতে জোট গঠনে সম্মত দলগুলো অভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে থাকবে। এর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়া ও জনমত তৈরি করা। যদিও এর কোনটিই হয়নি। শেষ পর্যন্ত নতুন জোটের উত্থান হবে নাকি অঙ্কুরেই নষ্ট হবে তাই এখন দেখার বিষয়। জাতীয় ঐক্যের ডাক একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিকল্প রাজনৈতিক জোট’ বা ‘বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তির উত্থান’ ঘটাতে ‘জাতীয় ঐক্যের’ ডাক দিয়েছেন ড. কামাল ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। গত ২৪ আগস্ট বিকল্পধারা সভাপতি বি. চৌধুরীর প্যাডে তার প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলমের স্বাক্ষরে গণমাধ্যমে পাঠানো যৌথ ঘোষণার কথা জানানো হয়। এর আগেও জাতীয় ঐক্যের কথা বলে রাজনীতিতে নানা কারণে বিতর্কিত ও সমালোচিত এ দুই নেতা হাত মিলিয়েছিলেন। যদিও সেই বন্ধুত্ব ছিল ক্ষণস্থায়ী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঐক্যের ডাক দেয়ার পর নিজেদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। গত রবিবার একটি মানববন্ধন করা হলেও এ নিয়ে শরিক নেতাদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া তৃতীয় ধারার এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় অন্য কোন দলও যুক্ত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তাদের যৌথ ঘোষণায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়, “এই পরিস্থিতিতে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি অহিংস বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। যৌথ ঘোষণায় একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলা হয়, দেশকে যারা ভালোবাসেন, যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, তাদের একটি প্রগতিশীল, পাহাড় ও সমতলের মানুষসহ সকল সম্প্রদায়ের পূর্ণ অধিকার সম্পন্ন একটি বাংলাদশে গড়ার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার ‘অর্থবহ পরিবর্তনের’ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানান প্রবীণ এই দুই রাজনীতিক। যৌথ ঘোষণায় তারা আরও বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির অংশগ্রহণ এবং অবাধ, সুুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন ব্যবস্থার দাবিতে এবং দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং সন্ত্রাসমুক্ত একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছাত্র সমাজ, শিক্ষিত ও সুধীজন, আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক, সাবেক সরকারীÑবেসরকারী কর্মকর্তাÑকর্মচারী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সমন্বয়ে বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে।
×