ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত গোয়েন্দাদের মধ্যে তোলপাড়

'সাহম আল হিন্দ’ চ্যানেলে জঙ্গী সালাউদ্দিনের সাক্ষাতকার

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

'সাহম আল হিন্দ’ চ্যানেলে জঙ্গী সালাউদ্দিনের সাক্ষাতকার

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ-ভারতীয় গোয়েন্দাদের ‘মাথাব্যথা’ জেএমবির আমির মৃত্যুদন্ড-প্রাপ্ত সালাউদ্দিন। তার একটি সাক্ষাতকার নিয়ে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তার সাক্ষাতকারে প্রকাশ পেয়েছে, জেএমবি জঙ্গীদের দাওয়াত তথা উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ ও কিতাল তথা সশস্ত্র যুদ্ধ। এতেই বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে আশঙ্কা ও ভয় উভয়ই কাজ করছে। শীর্ষ এই জঙ্গীর পুরো নাম সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। সম্প্রতি ঢাকায় আসা ভারতের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) ও জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় এই শীর্ষ জঙ্গীর অবস্থান এবং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। তাকে খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই ঐকমত্য পোষণ করে। ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা ও সিটিটিসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতে ধারাবাহিক জঙ্গীবিরোধী অভিযানে অনেক শীর্ষ জঙ্গী ধরা পড়েছে। তবে সে এখনও ধরা পড়েনি। তিন বছর আগে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সে জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আমিরের দায়িত্ব পালন করছে। এই শীর্ষ জঙ্গী এখন কোথায় আছে তা বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই অজানা। সালাউদ্দিন ভারতে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে বলে ঢাকার গোয়েন্দাদের ধারণা। সেখান থেকেই সে ঢাকায় জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ঢাকায় আসা ভারতের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) ও জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তাদের আলোচনার সময়ে এই শীর্ষ জঙ্গীর অবস্থান ও কার্যক্রমের বিষয়টি উঠে এসেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতের গোয়েন্দারাও সালাউদ্দিনকে নিয়ে কিছুটা ‘বিচলিত’। তাকে ধরতে না পারলে ফের জেএমবির তৎপরতা বাড়তে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কা-ের মতো অনুরূপ ঘটনা ভারতের মাটিতে আবারও ঘটানো হতে পারে এবং সেটা সালাউদ্দিনের নেতৃত্বেই ঘটতে পারে। এ ছাড়াও সালাউদ্দিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে জেএমবিকে সংগঠিত করাসহ জঙ্গী সংগ্রহ অভিযান চালাচ্ছে বলে ঢাকার গোয়েন্দাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে তার বিষয়ে খোঁজখবরের সাহায্য চেয়েছেন ভারতের গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের গোয়েন্দাদের আশঙ্কার কারণ হচ্ছে সালাউদ্দিনের সাক্ষাতকার। গত ১৩ জুলাই ‘সাহম আল-হিন্দ’ নামে জঙ্গীদের একটি চ্যানেলে তিনি জানান, তিনটি কর্মপদ্ধতি দাওয়াত বা উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ ও কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে জেএমবি আবার সংগঠিত হচ্ছে। এর মানে সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি জেএমবির সদস্যরা ফের কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে যাচ্ছে। এই শীর্ষ জঙ্গী সালাউদ্দিন সম্ভবত ভারতের মাটিতে অবস্থান করেই এই সাক্ষাতকার প্রদান করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, সালাউদ্দিন তো অবশ্যই আমাদের টার্গেট। ২০১৪ সালে প্রিজনভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে থেকে সে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তা অনুযায়ী সে ভারতে আছে। বিষয়টি সম্প্রতি ভারতের এসটিএফ ও এনআইএ-কেও জানানো হয়েছে। তারাও আমাদের মতো তাকে খুঁজছে। সালাউদ্দিন জেএমবির অনেক পুরনো নেতা। সে চুপচাপ আত্মগোপনে থাকবে না। সে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে পুরনো জেএমবি সংগঠিত হতে সময় লাগবে। কারণ তাদের বেশিরভাগ নেতাকর্মী কারাবন্দী। শীর্ষ কিছু নেতার অনেকের ফাঁসি হয়েছে। শুরুতে ভারতে আত্মগোপনে থেকে বাংলাদেশে জেএমবি তাদের কার্যক্রম সংগঠিত করে সে। এক সময় ভারতেও সমর্থক ও অনুসারী তৈরি হয়। সেখানে ছোট পরিসরে সাংগঠনিক কার্যক্রমও শুরু করে। তবে এ নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কোন ধারণাই ছিল না। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর নড়েচড়ে বসে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়া হয় তিন জঙ্গীকে। যার একজন পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বাকি দুজনের একজন, এই সালাউদ্দিন। তার সঙ্গে পুরনো জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে সুমন ওরফে হারুন ওরফে কামরুলও রয়েছে। বোমা তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী হওয়ায় যাকে বোমা মিজান বলেই চেনে সবাই। মিজানসহ সালাউদ্দিনকে ধরতে বাংলাদেশ পুলিশে ২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ৫ লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, জেএমবির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই কারাগারে এবং অনেকের ফাঁসির দ- কার্যকর হয়েছে। বাইরে অল্প যে কয়েকজন রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম এই সালাউদ্দিন, যাকে সোহেল, সজীব এবং তওহীদ নামেও ডাকা হয়। জেএমবির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই সে এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিষ্ঠাতা আমির আব্দুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাজ করেছে সে। ফলে তার বিষয়ে কিছুটা আশঙ্কা ও ভয় উভয়ই থেকেই যায়। তার মোটিভেশন ক্ষমতা অনেক বেশি। খুব অল্প সময়ে সে লোকজনকে মোটিভেটেড করে দলে ভেড়াতে পারে। অনেক বেশি ডেডিকেটেডও। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে যে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে সেসব বোমা তৈরি হচ্ছিল বাংলাদেশে হামলার জন্যই। তদন্তে ভারতীয় গোয়েন্দারা এ তথ্য জানতে পারেন। যা রয়েছে সালাউদ্দিনের সাক্ষাতকারে সাহম আল-হিন্দ-এ প্রকাশ হওয়া বিজ্ঞাপন আকারের ওই সাক্ষাতকারে জেএমবি কর্মনীতি সম্পর্কে সালাউদ্দিন বলেছেন, দীন কায়েমের ক্ষেত্রে আমরা কিতালের আকিদা পোষণ করি। জেএমবি যে কর্মপরিকল্পনায় এগোচ্ছে তা হচ্ছে, তা আমাদের লক্ষ্য হলো-আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেয়া পদ্ধতি কিতাল তথা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে শিরককে উৎখাত করে তাওহিদ তথা আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করে জান্নাত প্রাপ্তি। আমরা তিন দফা কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছি। তা হলো দাওয়াত তথা উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ ও কিতাল তথা সশস্ত্র যুদ্ধ। আমাদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে আইম্মাতু কুফর (কুফফারদের শক্তির কেন্দ্র) যাদের মাথা ভেঙ্গে দিলে অন্য অংশ এমনিতেই ভেঙ্গে পড়বে। তার ভাষ্যমতে, আমরা কিতালি কাজগুলো মাসালিহ (উপকার) এবং মাফাসিহ (ক্ষতি) এর মধ্যে ভারসাম্য রেখে সম্পাদন করা জরুরী মনে করি। যে মুজাহিদীনরা দীন প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন সেটা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই হোক তারা আমাদের থেকে আমরা তাদের থেকে। কার্যকর ও সুদৃঢ় ফল বয়ে আনে এমন টার্গেটকে প্রধান্য দিয়ে কর্মসূচী হাতে নেয়াই আমাদের কিতালি কর্ম পরিকল্পনা। গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন বলেন, জিহাদ গজওয়াতুল হিন্দে আমরা আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চে বুলন্দ করতে তিন দফা কর্মসূচী নিয়ে একযোগে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কোন ভূখ-ের সীমানা বর্ধিতকরণ বা কোন তাগুতি গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নামে যে জিহাদ, এসব থেকে আমরা আমাদের মুক্ত ঘোষণা করছি। যেভাবে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও উত্তর আফ্রিকার দেশে মুজাহিদরা হিজরতের মাধ্যমে জিহাদরত, ঠিক সেভাবে হিন্দুস্থানেও (ভারত) খিলাফাহ প্রতিষ্ঠায় আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা সালাউদ্দিনের জীবন-বৃত্তান্ত সংগ্রহ করেছি। তাকে এখন খুঁজছি। তাকে ও তার আরেক সহযোগী বোমা মিজানকে ধরতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ১৯৮০ সালের ২৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মাধবপাশায় জন্ম নেয়া সালাউদ্দিনও আগে জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সমর্থক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৭ সালে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় শিবিরের সাথী নির্বাচিত হয়। ওই বছরই এসএসসি পাসের পর সিলেট পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়। পরে ঢাকা পলিটেকনিক্যালে স্থানান্তর হয়ে ২০০১ সালে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে। ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের একটি নথি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে মেজভাই আব্দুল মতিনের মাধ্যমে যাত্রাবাড়ীর মোহাম্মদীয় আরাবিয়া মাদ্রাসার এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নাসরুল্লাহ ও ছানাউল্লাহ নামে দুই ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমেই পরিচয় হয় জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন আমির শায়খ আব্দুর রহমানের সঙ্গে। ওই বছরই সে শায়খ রহমানের সঙ্গে জঙ্গী কার্যক্রম বিস্তৃত করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে বাসাবোর একটি অফিসে বসে জেএমবির যে প্রথম শূরা কমিটি করা হয়, রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ, শাহেদ বিন হাফিজ, রানার সঙ্গে তাকেও শূরা কমিটির সদস্য করা হয়। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবেই কাজ করে আসছিল এই সালাউদ্দিন, যাকে ২০০৭ সালে একটি হত্যা মামলা ও ময়মনসিংহ আদালতে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুদন্ড- দেয়া হয়।
×