ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর সৃজনশীল চিন্তা, জলজ উদ্ভিদে বিপ্লব

প্রযুক্তিবিহীন পদ্ধতি ভাসমান ক্ষেতে চাষাবাদ

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রযুক্তিবিহীন পদ্ধতি ভাসমান ক্ষেতে চাষাবাদ

খোকন আহম্মেদ হীরা শৈশবে মধুমতী নদীর তীরে প্রযুক্তিবিহীন ভাসমান চাষ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার শৈশবের সেই চিন্তাধারা পরবর্তীতে বিকাশ লাভ করেছে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভাসমান চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর সৃজনশীল এই চিন্তাধারা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) স্বীকৃতি লাভের গৌরব শুধু দক্ষিণাঞ্চলবাসীর নয়, গোটা বাংলাদেশের। ভাসমান ক্ষেতে (ধাপ) সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক। এসব অঞ্চলের আবাদের ক্ষেত যখন পানিতে তলিয়ে থাকে তখন এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। বছরের সে সময়টাতে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিজেদের চেষ্টায় গাছের চারা ও ফসল উৎপাদনের এ উপায় বের করেন তারা। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃজনশীল চিন্তার ফসল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভাসমান চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে কৃষকদের। লোকসান আর হতাশার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে এখন তাদের (কৃষক) মুখে বছর জুড়েই থাকে হাসি। কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে ভাসমান জলাশয়ে ফসল চাষের এ পদ্ধতি কয়েক দশক ধরেই বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাধারায় সরকারের মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও সহায়তায় গত কয়েক বছর থেকে এ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করে সফলতা অর্জন করেছেন কৃষকরা। ভাসমান এ পদ্ধতিতে কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে লাউ, শিম, বেগুন, ফুলকপি, ওলকপি, বরবটি, করলা, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, ধনেপাতা, ডাঁটা, টমেটো, আদা, হলুদ, পেঁপে ও মরিচের চারা উৎপাদন করে বিক্রি করে বেশ অর্থ উপার্জন করছেন। বর্ষাকালীন ও শীতকালীন শাকসবজি উৎপাদনেও কৃষকরা নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা সদরের ভাসমান ক্ষেতের কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, জলজ জঞ্জাল শ্যাওলা, পানা ও কচুরিপানা আমাদের কাছে আশীর্বাদ। অবহেলিত এসব জলজ উদ্ভিদকে কাজে লাগিয়ে আমরা ফসল ও চারা উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছি। ভাসমান সবজি চাষে বানারীপাড়া, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, গৌরনদী ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার কৃষকদের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আগৈলঝাড়ার রাজিহার এলাকার কৃষক আব্দুল হক বলেন, ভাসমান ক্ষেতের পরিচর্যা ও বাণিজ্যের কাজটি পুরুষরা করলেও চারা উৎপাদন ও রোপণের কাজটি নারীরা করে থাকেন। কর্মপদ্ধতির বিষয়ে মিনারা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, ভাসমান ক্ষেতটির একটি বেড বা ধাপকে ট্যাপা, পানা ও কচুরিপানার মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ছয় হাতে একনল বলা হয়। একটি বেড লম্বায় ১০ থেকে ১৫ নলের মধ্যেই হয়ে থাকে। এসব ধাপ ইচ্ছেমতো পানির ওপরে নাড়াচাড়া করা যায়। তিনি আরও বলেন, একটি ধাপে দীর্ঘদিন ফসল ফলানো যায়। আর পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর সেই পচা কচুরিপানা জমিতে কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রথমে এ বেডে বীজের মাধ্যমে গাছের চারা উৎপাদন করা হয়। পরে ভাসমান ক্ষেতে সেই চারা রোপণ করা হয়। ২০ দিন পরেই এসব চারা বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। একইভাবে সবজির ক্ষেতও তৈরি করা হয়। স্থানীয় চাষী নাসির উদ্দিন বলেন, এভাবে চারা বা ফসল উৎপাদনে কোন সারের প্রয়োজন হয় না। তিনি আরও বলেন, ১০ নলের একটি বেডের ভাসমান কান্দিতে ১২শ’ লাউ, চার হাজার পেঁপে কিংবা চার হাজার মরিচের চারা লাগানো যায়। চাষী প্রবীর বিশ্বাস জানান, যতোই এ চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় হচ্ছে ততই উপকরণের দাম বাড়ছে। আগে যে ফসলের বীজ/আঁটি দুই শ’ টাকায় কেনা যেতো তা এখন ছয় থেকে সাত শ’ টাকা লাগে। একটি ধাপের জন্য এখন খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। আর প্রতিবার ওই ধাপের চারা বিক্রি করা হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ বলেন, কচুরিপানা কাজে লাগিয়ে সবজি উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকরাই প্রথম উদ্ভাবন করেছেন। এ পদ্ধতি দেশের জলাভূমিবেষ্টিত সব এলাকায় সম্প্রসারিত হলে বর্ষা মৌসুমে দেশের সর্বত্র শাকসবজির সঙ্কট ঘুচবে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কৌশল হিসেবে এ পদ্ধতির চাষাবাদে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার হয় না। ফলে চারা ও সবজি উভয়ই পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। তিনি আরও বলেন, পূর্বে প্রযুক্তিবিহীন কৃষকদের এ চাষাবাদ নিয়ে আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই শৈশবের চিন্তাধারাকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ভাসমান চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে আরও বিস্তার লাভ করেছে। ২০১০ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ভাসমান সবজি চাষীদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাপক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। বরিশাল বিভাগে আগে চার হেক্টর জমিতে চারা/সবজি উৎপাদন হলেও কৃষি বিভাগের তৎপরতায় এখন তা প্রায় ৩০ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। ফলে কৃষকরা এখন অধিক মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার মান পরিবর্তন করে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
×