ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবন

ভারত উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব অধ্যাত্মবাদের দেশ বলে খ্যাত এই অঞ্চলের যুগান্তকারী এক শুদ্ধ চেতনা। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কঠোর বর্ণাশ্রম প্রথা সারা ভারতবর্ষকে যখন অটল আর অচলায়তনের শক্ত বাঁধনে নির্জীব করে রাখে তখনই গৌতম বুদ্ধ তাঁর সাম্যের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হন। তিনি শুধু বর্ণাশ্রমের কঠিন নিগঢ়ই ভেঙ্গে দিলেন না, অহিংসা আর সম্প্রীতির মঙ্গলবার্তায় ধর্মীয় ভাবানুভূতিকে অন্য মাত্রায় নিয়েও গেলেন। নিজের অকৃত্রিম শুদ্ধ চেতনায় মানবতার জয়গান গেয়ে সর্বমানুষের কাছে যে অমৃতবাণী পৌঁছে দিলেন, সেখানে আজও তিনি অজেয় মহামানব, মনুষ্যত্বের এক অনির্বাণ দীপ্তি। যে দ্যুতিতে আলোকিত হলো শুধু ভারত উপমহাদেশ নয়, সারা এশিয়া মহাদেশ। তাঁর সাম্য, অহিংসা আর অমৃতবাণী একদিন সর্বমানুষকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছিল। এক সময় বার্মা বলে খ্যাত দেশটি এখন মিয়ানমার। বৌদ্ধ অধ্যুষিত এই দেশটিতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম থাকলেও সামরিক বাহিনীর প্রভাব প্রতিপত্তিও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এখানকার স্থানীয় জনসাধারণ এবং শাসকগোষ্ঠী সব সময়ই অধিকার আর স্বাধীনতা নিয়ে স্বাতন্ত্রিকভাবে বসবাস করত। যার কারণে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে এই ক্ষুদ্র দেশটিকে জয় করতে হয়েছিল। এমন কি ব্রিটিশরা যখন ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন বার্মাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদাও দিয়ে যেতে হয়। সেই থেকে দেশটি স্বাধীন এবং কড়া সামরিক শাসকের নিগড়ে আবদ্ধ। কালক্রমে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশটিতে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয় এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতাও চলে আসে। আর এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আউং সান সুচি, যাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়েছে। এক সময় বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে অনেক মুসলমান বার্মায় পাড়ি জমাতো ব্যবসাবাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। তারা পরিবার -পরিজন নিয়ে একসময় সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও শুরু করে দেয়। মিয়ানমারের রাখাইন সেই রকম একটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা, যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা অনেক বছর ধরে বাস করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে শাসক ও সামরিক বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনে এসব মুসলমান রোহিঙ্গা নিজেদের আবাসস্থল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এসব অসহায় আর নিরপরাধ রোহিঙ্গাদের আরকান বিদ্রোহী জঙ্গী সন্দেহে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী। আকাশ পথেও গান পাউডার ছিটানো হচ্ছে, যার দাবানলে জ্বলছে রাখাইনের রোহিঙ্গারা। বসতবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে। মেশিনগান আর বন্দুকের ছোড়া গুলিতে অসংখ্য রোহিঙ্গা হয় নিহত হচ্ছে, নতুবা ক্ষতবিক্ষত শরীরে যে কোন সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অনুপ্রেবেশে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব সহিংস ঘটনার সবচাইকে বেশি নির্যাতিত হয় অসহায় নারী আর শিশুরা। নারী নিপীড়ন এই বর্বর ঘটনার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে পুরো অবস্থাকে সর্বনাশের শেষ ধাপে নিয়ে যায়। সেদেশের শান্তির দূত আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা আউং সান সুচির এই সব অশান্তি আর অগণতান্ত্রিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন ধরনের উচ্চবাচ্য নেই। অথচ তিনি পররাষ্ট্র দফতরের মতো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দায়িত্বে অবস্থান করছেন। রোহিঙ্গা বিষয়টি একেবারে তার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত। এই অসহনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সূচির কোন উল্লেখযোগ্য কিংবা সক্রিয় পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনই করছেন না, বরং তাঁর এই নির্লিপ্ততা পুরো ঘটনাকে নানামাত্রিকে উসকে দিচ্ছে বললে বেশি বলা হবে না। শুধু মুসলমানই নয়, নংখ্যালঘু সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এই অকথ্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সারা বিশ্ব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হলেও তা যতখানি প্রয়োজন ছিল, সেই নিরিখে অনেক কম। আসলে পুরো ঘটনা পরস্পরকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে না দেখে মানবতা বিবর্জিত জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি জরুরী। সভ্যতা বিবর্জিত আদিম মানুষও সমগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে এমন নৃশংস হয়ে উঠতে পারেনি। যূথবদ্ধভাবে তারা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকত পারস্পরিক সহমর্মিতায়। চলনে, বলনে, আচার, ব্যবহারে, খাদ্যাভ্যাসে আদিম বন্য মানুষ সত্যিই সভ্য ছিল না। কিন্তু জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বসবাসও তাদেরকে সেভাবে পাশবিক করতে পারেনি বলে ইতিহাসে প্রমাণ মেলে। ঠা-া মাথায়, অকারণে, অপ্রয়োজনে অসহায় মানুষ হত্যা প্রাচীন কালের সভ্যতাবিহীন অন্ধকার যুগেও প্রচলিত ছিল না। নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য আর আন্তরিকতার বন্ধনে আবদ্ধ থাকত। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে না পারলে সবাই একসঙ্গে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যেত। আর আজ? সভ্যতার এমন বিকাশমান যুগে, তথ্যপ্রযুক্তির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি সর্বোপরি বিজ্ঞানের বহুমুখী প্রবহমান দীপ্তির ওপর যে পরিমাণ অশনিসংকেত, তার থেকে কিভাবে অসহায় মানুষ পরিত্রাণ পাবে? গৌতম বুদ্ধের শান্তি আর অমৃতবাণী আজ কোন অভিশাপে ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছে? যে ধর্ম মানুষে মানুষের প্রভেদ নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে, মানুষের মাঝে কোন পর্বতপ্রমাণ বাধা তৈরি করতে সবচাইতে বেশি অন্তরায় হয়েছে, তা আজ কোন অমঙ্গলের ছায়ায় সর্বনাশের সর্বশেষ পর্যায়ে নেমে এসেছে! ভীতসন্ত্রস্ত, বিপর্যস্ত রোহিঙ্গারা সেদেশের যে কোন সীমান্ত দিয়ে যেভাবে দেশ ছাড়ছে অত্যাচার আর নিপীড়নের মাত্রায়, তা সভ্যতাবহির্ভূত এক অমানবিক তা-ব। নদী পার হতে গিয়ে অনেকে নদী পথেই প্রাণ হারাচ্ছে, যেখানে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি। স্থলপথেও রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পারাপার এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এরই মধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অনাচার আর অবিচারের শিকার হয়ে স্বদেশভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আর এই ধরনের বাস্তুচ্যুত হবার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। থামার কোন উপায় তো নেই-ই, সামান্যতম প্রচেষ্টারও কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাদ-প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর ক্ষোভের মধ্যেই দায়িত্ব পালন শেষ হবে না। আরও সক্রিয় আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ সামনে খোলা নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব সীমান্ত এলাকা দিয়ে রাখাইনের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। সিংহভাগ সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশও এক অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সমস্যা যেহেতু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসে পড়েছে, তার সমাধানও সেভাবেই হওয়া আবশ্যক। সুতরাং জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সারা বিশ্বকে এই অনিবার্য সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। প্রথমত, মিয়ানমারের ওপর নৈতিক আর আইনী চাপ প্রয়োগে বলতে হবে, সংবিধান অনুযায়ী কোন নাগরিককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার অধিকার আসলে শাসকগোষ্ঠী থেকে আরম্ভ করে কারোরই নেই। আর তাই এই নারকীয় অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করে গৃহচ্যুত নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। একজন নাগরিকের সমস্ত মৌলিক অধিকার এবং আইনী বিধানে তাকে তার প্রাপ্য পাওনাটুকু দেয়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্বে অবহেলার দায়ভার অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বহন করে তার আশু সমাধান নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের মতো ঘন বসতিপূর্ণ দেশ যেখানে নিজেরাই জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত, সেখানে বহিরাগত অভিবাসীদের স্থান সংকুলান অত্যন্ত কঠিন একটি ব্যাপার। সমস্যার সমাধান করতে বাংলাদেশ এখন হিমশিম খাচ্ছে। এই ধরনের শরণার্থী সমস্যা আরও হরেক রকমের বিপর্যয় ডেকে আনে, যা পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে সময় নেয় না। সীমান্ত পারাপারে দালাল চক্রের জাল বিছানো তো থাকেই। তার ওপর নারী ও শিশু নির্যাতনের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অসংখ্য উদ্বাস্তুর অনুপ্রেবেশ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তার থেকে বেরিয়ে আসাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা ব্যাপার। অন্যায়, অবিচার আর সমাজ বিহর্ভূত অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়াও অমূলক নয়। গৃহ আর কর্মহীন মানুষদের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি শুধু ত্রাণসামগ্রীর ওপর নির্ভর করলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হতে পারে। স্থায়ী কোন সমাধান ছাড়া এই অসহনীয় বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া আসলেই কঠিন। চূড়ান্ত সমাধানের দায়িত্ব মিয়ানমারকেই নিতে হবে। নাগরিকের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে পুনর্বাসিত করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতের এক ক্রান্তিলগ্নে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। বর্ণবাদবিরোধী এই ধর্মে সাম্প্রদায়িক কোন্দলের কোন স্থান কিংবা সুযোগ নেই। নির্বাণেই অনন্ত যাত্রায় পরম শান্তি, এই বোধেই বুদ্ধ ইহকাল-পরকালের সমৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের অবাধ মিলনের স্বপ্নই দেখেছেন বৌদ্ধধর্মের এই প্রাণপুরুষ। নিজেকে কখনও অবতারের আসনে বসাননি। যদিও তাঁর অনুসারীরা তাঁকে সে জায়গায় নিয়ে আসে। শেষমেশ তাঁর কিছু অনুগামীর হাতে এ ধরনের নির্মম পাশবিক ধ্বংসযজ্ঞ ভাবাই যায় না। আসলে এটা শুধু সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়, বড় ধরনের এক মানবিক বিপর্যয়ও, যা কোন রাষ্ট্র ও ধর্মই মেনে নিতে পারে না। আর এর সমাধানও মানবিক মূল্যবোধের নিরিখেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। লেখক : সাংবাদিক
×