ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

জিন প্রযুক্তি ॥ পশুচর্ম ছাড়াই তৈরি হবে চামড়া

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জিন প্রযুক্তি ॥ পশুচর্ম ছাড়াই তৈরি হবে চামড়া

চামড়া তৈরি এক সুপ্রাচীন শিল্পকর্ম। চামড়ার তৈরি এ পর্যন্ত প্রাচীনতম যে জিনিসটি পাওয়া গেছে সেটি সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের একটি জুতা যা আর্মেনিয়ার একটি গুহায় পাওয়া যায়। তবে মিসরীয় সমাধিগুলোর গায়ে উৎকীর্ণ চিত্রকর্মে দেখা যায় যে, চামড়া দিয়ে স্যান্ডেল থেকে শুরু করে বালতি এমনকি সামরিক উপকরণ পর্যন্ত নানা ধরনের জিনিস তৈরি করা হতো। পোশাক তৈরির কাজে পশুচর্মের ব্যবহার যে হাজার হাজার বছরের পুরনো কৌশল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চামড়া তৈরির কাজটা আগে অত্যন্ত বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর লন্ডনে পশুর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে মূত্র ও চুনের মিশ্রণে চুবিয়ে নেয়া হতো, যাতে করে মাংস বা পশমের কিছু লেগে থাকলে তা আলগা হয়ে যায়। পরে সেই চামড়া নরম ও সংরক্ষণ করার জন্য তাতে কুকুরের বিষ্ঠার প্রলেপ দিয়ে নেয়া হতো। এতে চারপাশের পরিবেশে এমন এক উগ্র ও কটু ‘গন্ধ’ ছড়িয়ে পড়ত যে, নগরীর মূল অংশে চামড়া তৈরির কারবার নিষিদ্ধ করে বাতাস যেদিকে প্রবাহিত হয় সেদিকে ও নদীর তীরে সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। ভারত ও জাপানে চামড়া তৈরির কারবারে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ জড়িত ছিল। চামড়ার আধুনিক উৎপাদন কৌশল অষ্টাদশ শতকের কৌশলের মতো ঘিনঘিনে ও শরীর গুলিয়ে দেয়ার মতো নয়। মূত্র, চুন ও কুকুরের বিষ্ঠার পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রোমিয়াম ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য। কিন্তু কিছু কিছু রাসায়নিক পদার্থ বড়ই উগ্র ও কটু এবং সেগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরও বটে। তার পরও চামড়া শিল্প এক বিশাল শিল্প। বার্ষিক চামড়া ব্যবসার মূল্য ১০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। এমন প্রলুব্ধকর এক ব্যবসা যে প্রযুক্তির উৎকর্ষে উৎসাহিত করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতেই আজ পাকা চামড়া সত্যিকার অর্থে এক প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে চলেছে। এ থেকে যে কারোর ধারণা হতে পারে সেই প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিকল্পটি হয়ত সিনথেটিক পলিমারের কোন কিছু। কিন্তু না, তা নয়। সেই বিকল্পটি হচ্ছে এমন একটি জিনিস যা বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে স্বাভাবিক চামড়ার অনুরূপ। পার্থক্য এইটুকু যে সেই চামড়া পশুর গা থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হয় না, বরং তা কারখানায় উৎপাদন করা হয়। পশু হত্যা না করেও কারখানায় চামড়া উৎপাদনে যে কৌশলটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি হলো জিন প্রকৌশল। কৌশলটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এই কৌশল অবলম্বনে যে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে অগ্রসর তার নাম ‘মডার্ন মিডো’। এটি একটি মার্কিন কোম্পানি। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে কোম্পানির ৬০ জন স্টাফ নীরবে নিঃশব্দে চামড়ার এক নতুন রূপ উদ্ভাবন করেছে। অতঃপর তারা নিউজার্সির নাটলিতে এক ল্যাবরেটরিতে সেই চামড়ার পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। কোম্পানিটা তার উৎপাদিত পণ্য দুই বছরের মধ্যে বাজারে আনতে পারবে বলে আশা করে। প্রাণীদেহ থেকে নেয়া চামড়ার তুলনায় কারখানায় উৎপাদিত চামড়ার বেশকিছু সুবিধা থাকার সম্ভাবনা আছে। একটা হলো, এই চামড়া সুবিধাজনক শিটে বানানো যাবে যার প্রান্তগুলো হবে সোজা। অন্যদিকে পশুর চামড়ার সীমাবদ্ধতা হলো সেগুলোর আকার পশুর দেহ অনুযায়ী অসম হয়। দ্বিতীয় সুবিধা হলো, স্বাভাবিক চামড়ার তুলনায় এগুলো অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ গুলোতে কোন দাগ, চিহ্ন ও অন্যান্য খুঁত থাকবে না, যা প্রকৃত চামড়ায় অনিবার্যভাবেই থেকে যায়। এক পশু থেকে আরেক পশুর স্বাভাবিক চামড়ার তারতম্য থাকে। কিন্তু এই চামড়ার ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোন তারতম্য হবে না। এসব কিছুর ফলে অপচয় কমবে এবং গুণগত মান বাড়বে। কারখানায় চামড়া তৈরির জন্য ‘মডার্ন মিডো’ ঈস্টের একটি স্টেইন দিয়ে কাজ শুরু করেছে। জিন প্রকৌশলের দ্বারা সেই ঈস্টটি এমনভাবে পরিবর্তিত করা হয়েছে, যার ফলে সেটি বোভাইন কোলাজেনের অনুরূপ একটি প্রোটিন তৈরি করতে পারে। কোলাজেন হচ্ছে প্রাণী দেহের প্রধান কাঠামোগত প্রোটিন। বিশেষ করে এটি গাত্রচর্মকে শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা যোগায়। এটি সব প্রোটিনের গঠনকারী উপাদান এ্যামাইনো এ্যাসিডের সুদীর্ঘ শৃঙ্খল দিয়ে গঠিত। এটা ত্রয়ীরূপে পাক খেয়ে নিয়ে ট্রিপল-হেলিস তৈরি করে এবং এই ট্রিপল-হেলিসও পরে পাক খেয়ে ফাইবার বা তন্তু তৈরি হয়। পশুর চামড়ার ক্ষেত্রে এ্যামাইনো এ্যাসিডের শৃঙ্খলগুলোর সংশ্লেষণ ও পরবর্তীকালে সেগুলোর পাক খেয়ে আঁশ বা তন্তুতে পরিণত করার কাজটা বিশেষ কতগুলো সেল বা কোষ দিয়ে করা হয়, যেগুলোকে বলা হয় ফাইব্রোব্লাস্ট। ‘মডার্ন মিডো’র জৈব প্রকৌশলীরা এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল করায়ত্ত করেছেন। তা হলো তারা ফাইব্রোব্লাস্টের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এ্যামাইনো এ্যাসিডের শিকলগুলোকে আপনা আপনি একত্রে পাক খেয়ে তন্তু বা আঁশে পরিণত হতে দেয়। একবার আঁশ বা তন্তু তৈরি হয়ে গেলে সেগুলোকে আপনা থেকেই কয়েকটি স্তরে পরিণত হতে দেয়া এবং এভাবে কাঁচা চামড়ার শিট তৈরি করা কঠিন কিছু নয়। জৈব প্রকৌশলীরা কি কৌশলে ফাইব্রোব্লাস্টের সাহায্য ছাড়াই আঁশ বা তন্তু তৈরি করতে পেরেছেন, তা অবশ্য জানাতে রাজি হননি। তবে কোম্পানির প্রধান প্রযুক্তি অফিসার ডেভ উইলিয়ামসন জানিয়েছেন যে, এই প্রক্রিয়ায় বিশাল বিশাল কারখানায় কোলাজেন তৈরি করা এবং পরে তা চামড়ায় রূপান্তরিত করার জন্য ছোট ছোট কারখানা বা ট্যানারিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। দামের দিক দিয়ে এই নতুন চামড়াটি হবে পশুচর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। ‘মডার্ন মিডো’র উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটা সুবিধা হলো এতে করে চামড়ার একটা শিটের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করা যাবে। এতে করে উৎপাদিত চামড়ার চেহারা ও পণ্যটি সম্পর্কে অনভূতি নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বদলানো যেতে পারে। যেমন একটি অংশকে শক্তভাবে এবং অন্য অংশটিকে নরমভাবে বানানো যেতে পারে। ফলে একটা শিট দিয়েই জুতার শক্ত অংশ এবং অন্য অংশ দিয়ে জুতার নরম অংশ তৈরি করা যেতে পারবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×