ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নুরজাহান সাথী

বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক

রবি ঠাকুরের আবেগি ভাষায় মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে। শুধু বাঙালী কেন পৃথিবীর সকল জাতির সকল সম্পর্কের শীর্ষে মা-সন্তানের নৈকট্য। প্রাণ জাগরণের পর প্রথম সাক্ষাতই মায়ের সঙ্গে। যার শরীর শুষে বেড়ে ওঠে প্রাণের গঠন। সুতরাং সম্পর্কের আস্থাই মা-সন্তানের বিফলতা ভাবার যোগ্য নয়। তবে শাশুড়ি ও মা আবার বৌমাও সন্তান। এটাও একটি অস্বীকারের অযোগ্য সম্পর্ক। আজকাল হারহামেশাই মেয়েদের বলতে শোনা যায় ‘মা আমার ভাল বন্ধু’। উক্তিটি চমৎকার। মা-সন্তান দুই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধির বন্ধুত্ব যেমন আধুনিকতার প্রয়াস তেমনি বৌ-শাশুড়ির বন্ধুত্ব আরও অত্যাধুনিক। একটি মেয়েশিশু একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবারের নিজস্ব ধারায়, পরিবেশে, এবং বিশ্বাসের সঙ্গে বেড়ে ওঠে। সাবালোক হয়ে যখন বিয়ে হয় তখন তাকে আবার একটি নতুন পরিবেশে জড়াতে হয়। এবং এই পরিবেশ পাল্টনোর ব্যাপারটা মা-মেয়ের দুইজনকেই রপ্ত করতে হয়। একজন মা তার নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন্য পরিবেশে স্থানান্তর করে আবার ছেলে বিয়ে দিয়ে মেয়েতুল্য বৌমা ঘরে আনে। তেমনি মেয়েকেও এক মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাতুল্য শাশুড়ির কাছে যেতে হয়। যদিও পরিস্থিতি সবার ক্ষেত্রে সমান হয় না। সুতরাং মা হিসেবে শাশুড়ি মা আর সন্তান হিসেবে বৌমা, কারও কাছে কারও তাৎপর্য কম নয়। সম্পর্কটা শুধু ছেলের বৌ বা স্বামীর মা পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। দুটি প্রজন্ম একই পরিবারে দুটি সময়ের দুইজন দায়িত্বশীল মানুষ। সে জন্য শাশুড়িকে হতে হয় মা আর বৌমাকে হতে হয় মেয়ে। এক পরিবেশের বুলি অন্য পরিবেশের গালি। সুতরাং পরিবেশ বুঝে চললেই সমাধান। মেয়েরা বাবার বাড়িতে যে পরিবেশে বড় হয় স্বামীর বাড়ি সে পরিবেশ নাও থাকতে পারে। ব্যক্তিগুলোর মধ্যেও পার্থক্য থাকতে পারে। নিজের মায়ের আদর, ভালবাসা, উপদেশ, আদেশ, নিষেধ, শাসনের ধরন আর শাশুড়ির আদর, ভালবাসা, উপদেশ, আদেশ, নিষেধ, শাসনের ধরন আলাদা রকম হবে। তেমনি নিজের মেয়ের আদর-আবদার, ভালবাসা, অভিমান-অভিযোগের ধরন আর বৌমার ধরন আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিভেদে প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি একই মায়ের দুই মেয়ের প্রকাশভঙ্গি দুই রকম হতে পারে। তবুও দুটিই সন্তান। কিন্তু ভালবাসা তো ভালবাসাই, শাসন তো শাসনই আর যিনি মা তিনি তো মা তেমনি সন্তান যেমনি হোক তাকে অস্বীকার করা যায় না। শুধু উপস্থাপনার ভিন্নতা। সুতরাং সন্তানজ্ঞানে বৌমাকে মেয়ে এবং মাতৃজ্ঞানে শাশুড়িকে মা, পরস্পরের এই সৌহার্দ্যপূর্ণ বস্যতাই তৈরি করতে পারে বৌ-শাশুড়ির বন্ধন। এ জন্য শাশুড়ির উচিত একটা সহনীয় পরিবেশ বৌমাকে উপহার দেয়া। তেমনি বৌকেও নতুন পরিবেশকে উপভোগ্য করে মেনে নিতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবার আছে যেখানে বৌ-শাশুড়ির মধ্যে কলহ দেখা যায়। এই কলহের জের ধরে সংসারও ভেঙ্গে যায়। বেশিরভাগ পরিবারে পুরুষ সদস্যরা দিনের অনেকটা সময় বাইরে থাকে সে ক্ষেত্রে বৌ এবং শাশুড়িকে থাকতে হয় ঘরে। যদি এই দুইয়ের মধ্যে কলহ থাকে তাহলে ওই সময়টাতে একই বাসায় দুইজন আলাদা আলাদাভাবে একাকিত্ব বোধ করে। আর যদি বৌ-শাশুড়ির মাঝে সুসম্পর্ক থাকে তাদের ওই সময়টা হয়ে ওঠে আরও বেশি আনন্দদায়ক। যেমন কাজে-ক্ষেত্রে গল্প-আড্ডায় শেয়ার করা, সকলে মিলে কাজ করা, পারিবারিক যে কোন সিদ্ধান্তে দ্বিধাহীন অংশগ্রহণে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর বৌ-শাশুড়ির সুসম্পর্ক রক্ষার্থে কিছু কাজ নিয়ম করে করা উচিত। মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, একসঙ্গে রান্না করা, সাংসারিক বিভিন্ন কাজ একসঙ্গে করা, আইডিয়া ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করা ইত্যাদি। প্রথমত, বৌ-শাশুড়ির সম্পর্ক ভাল থাকলে মা-ছেলে এবং স্বামী-স্ত্রীর উভয় বন্ধন ভাল থাকে। এর প্রভাবে পরিবার থেকে আত্মীয়বর্গের মাঝেও এক ধরনের ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরি হয় যা ক্রমান্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধে পরিণত হয়। ভবিষ্যত প্রজন্মও পরিবার থেকে মূল্যবোধ, শিক্ষা ও সম্পর্কের সৌহার্দ্যতা উপলদ্ধি করার যোগ্যতা অর্জন করে। ভেবে দেখুন যে পরিবারে স্বামী-ন্ত্রী ও শাশুড়ির মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সে পরিবারের নতুন প্রজন্মরাও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার শিক্ষা লাভ করে। যে কারণে সেসব শিশুরা ইতিবাচক মানসিকতার সঙ্গে বড় হওয়ার সুযোগ পায়। বৌ-শাশুড়ির মাঝে কলহপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় যে কোন একজন অথবা দুইজনেরই মানসিক সংকীর্ণতা থেকে। যদি মাতৃজ্ঞানে মেয়েতুল্য বৌমাকে মেয়ে না ভাবা হয় আর সন্তানজ্ঞানে মা তুল্য শাশুড়িকে মা না ভাবা যায় তাহলে মাতৃত্ব এবং মাতৃপ্রেম দুটিই নিরেট স্বার্থপরতার পরিচয় দেয়। একসঙ্গে থাকতে গেলে সবসময় সবকিছু ঠিক ধারাতে চলে না। ভুল বোঝা, দায়িত্বে অবহেলা, মান-অভিমান হতেই পারে। তাই বলে একে-অন্যের প্রতি সম্মান ¯স্নেহ থাকবে না সে রকম হওয়া কাম্য না।
×