ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

ষড়যন্ত্র ধোপে টিকবে না

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ষড়যন্ত্র ধোপে টিকবে না

দীর্ঘকাল ধরে আঘাতের পর আঘাত এসে বাঙালীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলাই যেন এক রকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই নিয়মকে ভেঙ্গে দিয়ে আওয়ামী লীগ সব মর্মান্তিক শোকগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এতে চক্রান্তকারী গোষ্ঠীর চোখে শূল বিঁধছে, গায়ে জ্বালা ধরে গেছে। তাই তারা আষ্টেপৃষ্ঠে সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রে মত্ত হচ্ছে। নির্বাহী বিভাগ আর বিচার বিভাগের মধ্যকার টানাপোড়েন সৃষ্টি সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। হাওরের আগাম বন্যা, পাহাড়ধস, অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে না দিতেই বন্যায় তলিয়ে গেছে জেলার পর জেলা। বানের জলে ভেসে গেছে লাখ লাখ মানুষের সম্পদ ও স্বপ্ন। প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। দিশেহারা মানুষদের সহায়তা করতে, আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসাসহ সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন কঠিন পরিস্থিতির মাঝেই প্রধান বিচারপতি কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় আসে। রায়ে দেশের রাজনীতি, শাসন ব্যবস্থা, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। সেই পর্যবেক্ষণ নিয়ে দেশে সৃষ্টি হয়েছে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। রায়ের পর্যবেক্ষণে বহু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আনা হয়েছে। যেসব মন্তব্য করা হয় তাকে অনেকেই যুক্তিতাড়িত নয় বরং বিদ্বেষতাড়িত বলে মনে করছেন। আবার কেউ এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের আভাসও পাচ্ছেন। সরকারের সব বিভাগ সম্পর্কে ‘বিরূপ’ মন্তব্য করায় প্রধান বিচারপতি আসলে কী চাচ্ছেন সেটা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ১৯৭২ সালে রচিত ও গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ ধারা মোতাবেক, দায়িত্বের মেয়াদ সমাপ্তি ব্যতীত অন্য যে কোন কারণে যথা অসদাচরণ বা অদক্ষতা, উচ্চতর আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল পার্লামেন্টকে। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের ওপর থেকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। সামরিক আইন ফরমান বা মার্শাল ল’ প্রোক্লেমেশন দ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাত থেকে সরিয়ে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করেন। পাকিস্তানে সুপ্রীম জুডিশিয়াল আছে। সেই আদলেই জিয়াউর রহমান তা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাটি সন্নিবেশিত ছিল। ষোড়শ সংশোধনীতে তা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয় সংসদকে। সেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন আদালত। এই বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেছেন, ‘সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই রায় দেশকে বিচারিক প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মার্শাল ল’ আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে যেহেতু সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থী।’ এটা তাঁর এবং অন্য অনেকের অভিমত। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে রায়ের সংশ্লিষ্টহীন পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিতর্কÑ যা ছিল অনভিপ্রেত এবং অপ্রত্যাশিত। পর্যবেক্ষণে সংসদকে অপরিপক্ব বলা হয়েছে। সংসদ দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই বিচারপতিদের নিয়োগ দেন। সংসদ অপরিপক্ব হলে তাদের নিয়োগও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের অপমান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যেহেতু তারা জনগণ দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত নন, তাই তাদের বিচারপতিদের অভিশংসনে অংশ নেয়াটা গণতন্ত্রবিরোধী। তাহলে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অভিশংসনে সংরক্ষিত নারী সাংসদদের অংশ নেয়ার বিষয়টির কী হবে? ওই ধারা তো বাতিল করা হয়নি। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, মানবাধিকার হুমকির মুখে, দুর্নীতি অবাধ, সংসদ অকার্যকর, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত কয়েক কোটি মানুষ আর প্রশাসনে অব্যবস্থাপনা মারাত্মক। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই রাতারাতি এগুলো মুক্ত বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে। তবে আগের যে কোন সরকারের আমলের চেয়ে এখন অনেক ভাল পরিস্থিতি এদেশে বিরাজ করছে। সরকার প্রাণপণ এগুলো থেকে পরিত্রাণের প্রয়াস চালাচ্ছে, অথচ হতাশাব্যঞ্জক পর্যবেক্ষণ দিয়ে উন্নয়নকামী সরকারের সেই প্রচেষ্টাকেই যেন খাটো করা হলো। আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে অস্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে আপীল বিভাগে নিয়োগ পান তিনি। বিএনপি আমলে স্থায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদে তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। একবার চারজন বিচারপতির সমন্বয়ে আপীল বিভাগের বেঞ্চ যখন যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের আপীল শুনছিলেন তখন জনাকীর্ণ আদালতে প্রধান বিচারপতি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, তিনি ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তাঁর এমন স্বীকারোক্তিতে সেদিন সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। অনেকের তখন মনে পড়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী রাজা ত্রিদিব রায়ের কথা। প্রধান বিচারপতির এ আত্মস্বীকৃত বক্তব্য পরের দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে ডেইলি ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় ২য় শীর্ষ সংবাদ হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল “ঔঁংঃরপব ঝরহযধ ফরংপষড়ংবং যরং ৎড়ষব রহ ১৯৭১”. যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের মামলা চলাকালে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাঁর মন্তব্য শুনে সেই সময় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। সাকা চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। তবে অবশ্য উদ্বেগজনক কিছু ঘটেনি। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি আদালতে এ্যাটর্নি জেনারেলকে সতর্ক করতে গিয়ে কেবল হুঁশিয়ারিই দেননি, এমন উদাহরণ টেনে এনেছেন যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের জন্য কষ্টের। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিচার বিভাগ ধৈর্য ধরছি। যথেষ্ট ধৈর্য ধরছি। আজকে একজন কলামিস্টের লেখা পড়েছি, সেখানে ধৈর্যের কথা বলা আছে। পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে ইয়ে (অযোগ্য) করেছেন। সেখানে কিছুই (আলোচনা-সমালোচনা) হয়নি। আমাদের আরও পরিপক্বতা দরকার।’ যে পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে, যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারণকারী জনগণের তীব্র কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বৈকি। তাছাড়া পাকিস্তান হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতা ও সামরিকতন্ত্রভিত্তিক একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। সে দেশে যেখানে বিচার বিভাগ ও সরকারের ক্ষমতার উৎস ক্যান্টনমেন্ট সেখানে এদেশে ক্ষমতার উৎস জনগণ। তাই এই দুই দেশের মধ্যে তুলনায় জনগণ হতবাকই হয়েছে। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে ওয়ান ইলেভেনের প্রধান কুশীলব সেই সব সুশীল ব্যক্তিবর্গের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, এরা আগের মতোই নতুন কোন ষড়যন্ত্রের খেলায় মত্ত হয়েছেন। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে অঘটন ঘটন পটিয়সী বিএনপি-জামায়াত চক্র। রায়ের পর থেকেই মনে হচ্ছেÑ জামায়াত-বিএনপির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এরাই একসময় প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহসহ আদালত প্রাঙ্গণে নানা জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে। আর এখন স্বার্থের কারণে এরাই প্রধান বিচারপতির বন্ধু সাজার চেষ্টা করছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে এদের উচ্ছ্বাস, মিডিয়ায় দেয়া কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা বিজয় অর্জন করে ফেলেছে, এখন কেবল ক্ষমতায় বসার অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু পনেরোই আগস্ট, সতেরোই আগস্ট ও একুশে আগস্টের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যে এই বাংলার মানুষ কিছুতেই ক্ষমা করবে না, এটা সহজেই বোধগম্য। তাই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। তারা যতই ষড়যন্ত্রের জাল বুনুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারণকারী বাঙালী সেই ষড়যন্ত্র ছিন্ন করবে। আইন, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাই সরকারের উচিত দেশের প্রয়োজনে ত্বরিত এই উদ্ভূত সমস্যা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পবিত্র ঈদ-উল-আযহার শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির মধ্যে যে হাস্যোজ্জ্বল আন্তরিক ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে সেই রকম পরিস্থিতিই যেন আইন, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিরাজমান থাকে, সেটাই চায় বাংলার মানুষ। রাষ্ট্রের এই তিন বিভাগের মধ্যে সুসমন্বয় বিরাজ থাকলেই সকল বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র নসাৎ হবে, দুর্বার গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবে দেশ, গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে সেই চেষ্টাই সবার করা উচিত। লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×