ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সক্রিয় গ্রাহক, এজেন্ট উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত

ভুয়া মেসেজ, ফোন কল॥ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারক চক্র

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ভুয়া মেসেজ, ফোন কল॥ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারক চক্র

রহিম শেখ ॥ বিকাশ কর্তৃপক্ষ পরিচয়ে +১৬২৪৭ নাম্বার থেকে প্রথমে ফোন কল। পরে খুদে বার্তা। জানানো হলো, মোবাইলে ক্যাশ ইন করার ক্ষেত্রে কমিশন কাটা হবে বাজার মূল্যের অর্ধেক। পাবেন ভিআইপি গ্রাহকের মর্যাদা। এ ধরনের প্রলোভনের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে দুই দফায় নিজের নাম্বারে ২০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গোলাম মোস্তফা। পরে দুটি ব্যক্তিগত নাম্বারে টাকা পাঠান তিনি। অর্থ হস্তান্তরের পর তিনি জানতে পারেন প্রতারক চক্র তার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। রবিবার রাজধানীর বাংলামটরে বিকাশের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গিয়ে অভিযোগ জানালে বলা হয়, যে নাম্বারটি থেকে ফোন বা খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে সেটি তাদের নয়। বিকাশের নিজস্ব নাম্বারে (+) শব্দটি নেই। কোন প্রতারক চক্র এটি করেছে। ফলে টাকা উদ্ধার হবে কি-না তা জানাতে পারেনি বিকাশ কর্তৃপক্ষ। ফোন কল বা খুদে বার্তার মাধ্যমে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কায়দায় প্রতিদিনই গোলাম মোস্তফার মতো এমন অনেক গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এ অবস্থায় অর্থ লেনদেনে গ্রাহকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। পুলিশের দাবি, এসব চক্রকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। জানা গেছে, দ্রুততম সময়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে টাকা পাঠানোর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম এখন মোবাইল ব্যাংকিং। বর্তমানে এ সেবা ব্যবহার করেই মানুষ তাদের পরিবার পরিজন ও নিকটাত্মীয়ের কাছে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন। এছাড়া এ সেবার মাধ্যমে রেমিটেন্সের অর্থ প্রেরণ, বেতনÑভাতা ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ সবই উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। মূলত ব্যাংকে গিয়ে অর্থ আদান প্রদানের ঝামেলা এড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার গ্রাহক। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেশ কিছু প্রতারক চক্র। গড়ে উঠছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট চক্র। থামানো যাচ্ছে না গ্রাহক হয়রানি। এক হিসাবে দেখা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকার লেনদেনই বেশি। সাধারণত যারা অল্প আয়ের মানুষ এবং যারা ব্যাংকে গিয়ে এ্যাকাউন্ট খোলার মতো দক্ষ নন, তাদের একটি বড় অংশ এ ব্যাংকিং সেবার দিকে ঝুঁকছেন। এতে একবারে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা লেনদেন করা যায়। তবে কেউ চাইলে একাধিক এজেন্ট বা এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরও অনেক বেশি টাকা লেনদেন করতে পারেন। তবে এই লেনদেনের তেমন কোন তথ্য থাকে না। এজেন্টের মাধ্যমে করলে যার কাছে টাকা পাঠানো হয়, তার মোবাইল নম্বর ছাড়া আর কোন তথ্যই থাকে না। আর সেটার সুযোগ নিয়েই মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে অবৈধ কাজে টাকা ব্যবহার হচ্ছে। ভুয়া মেসেজের মাধ্যমে এজেন্টরা যেমন টাকা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি গ্রাহকের টাকাও তুলে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ভুরি ভুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থসংরক্ষণ কেন্দ্রে আসা একাধিক অভিযোগ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অপরাধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, নোবেল লরিয়েটের সঙ্গে ডিনার প্রোগ্রাম, সুলভমূল্যে ফ্ল্যাট-প্লট প্রদান ও জিনের বাদশার কথা বলে অর্থ আদায়, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচার, চুরি, হ্যাকিং, ন্যাশনাল আইডি কার্ড জালিয়াতি, সিএনজি ও অটোরিক্সা ছিনতাই প্রভৃতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যবসায়ী মোকারম হোসেন শামীম সম্প্রতি অভিযোগ করে বলেন, গ্রামীণফোন সিম ০১৭৮০১৫৯৯৭৪ নম্বরের মাধ্যমে বিকাশে নিয়মিত লেনদেন করেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে সিম কার্ডটির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ দেখায় এবং পরবর্তী সময়ে তার এ্যাকাউন্ট থেকে ভৌতিকভাবে ২২ হাজার টাকা উধাও হয়ে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামীম হারানো টাকা ফিরে পেতে বিকাশ হেড অফিস ও গ্রামীণফোন অফিসে ছুটে যান। কিন্তু এর কোন সুরাহা না পেয়ে দিশেহারা এই গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ করেন। আবুল বাশার নামে অন্য এক গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে করা অভিযোগে বলেন, ব্যবসায়িক কাজে বিকাশে ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট খুলি। কিন্তু হঠাৎ চালু সিমটি বন্ধ দেখায়। রেজিস্ট্রেশন নষ্ট হয়েছে মনে করে পাশের এসটিপিতে গিয়ে দেখি তার এ্যাকাউন্ট থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসিফ হোসেন অভিযোগ করেন, গ্রামীণফোন সিম ০১৭০৯৩০৬১৯৫ নম্বর থেকে গত শুক্রবার একটি ফোন আসে। বিকাশ অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়ে আমাকে বলা হয়, আপনার হিসাবে ২ হাজার ৪০ টাকা রয়েছে। তবে বর্তমানে এ্যাকাউন্টটি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সক্রিয় করতে আমাদের নির্দেশনা অনুসরণ করুণ। মুহূর্তেই মোবাইলে থাকা ২ হাজার ৪০ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। তিনি বলেন, এই প্রতারক চক্রটির সঙ্গে এজেন্টরা জড়িত থাকতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তুলনামূলকভাবে যারা অসচেতন তাদের ভুল বুঝিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অন্যের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য বড় ধরনের সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় রয়েছে। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দক্ষ কায়দায় তারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের টাকা লুফে নিচ্ছে। তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন অবসরে যাওয়া সরকারী চাকরিজীবী, সেনা কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থেকে শুরেু করে সুশীল সমাজের সদস্যরা পর্যন্ত । এ প্রসঙ্গে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা ও লেনদেন যেমন বেড়েছে তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার ধারাবাহিকতা এবং কঠোর নজরদারির কারণে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রবৃদ্ধিও একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। তবে সবচেয়ে জরুরী হলো গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। আমাদের গ্রাহকদের বলব, যদি কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হয় তাহলে অবশ্যই যেন আমাদের কাস্টমার কেয়ারে বিষয়টি জানায়। তিনি আরও বলেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে বিকাশ কর্তৃপক্ষ ৪টি সতর্কতামূলক বার্তা দিয়েছে। এসব অনুসরণ করলে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ১. নিজের বিকাশ এ্যাকাউন্টের পিন নম্বর ও এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স কখনও কাউকে বলবেন না। ২. ফোনে কেউ যদি আপনাকে ভুল করে টাকা পাঠানোর কথা বলে ফেরত চায় সন্দেহ হলে এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স চেক করুন। ৩. কারও প্ররোচনায় লটারি জেতার মিথ্যা আশায় কোন লেনদেন করবেন না। ৪. ফোনে শুধু কারও কথা শুনে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কারও নির্দেশনায় কোন নম্বর ডায়াল করবেন না বা টাকা পাঠাবেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এই ধরনের অপরাধ আমাদের নজরে আছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। বেশ কিছুদিন ধরে এই ধরনের অভিযোগ বেশি পরিমাণে আসছে। অপরাধে জড়িত কয়েকটি চক্রকে গ্রেফতারও করেছি আমরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী শুধু মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাকাউন্ট রয়েছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ মাধ্যমে লেনদেন করবে। তবে বেশিরভাগ এজেন্ট এ নিয়ম না মেনে নামে-বেনামে এ্যাকাউন্ট খুলে টাকা পাঠায়। এর ফলে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবৈধ লেনদেন বাড়ছে। কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে এ ধরনের কয়েক লাখ এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন এজেন্ট। বাতিল করা হয় অনেকের এজেন্টশিপও। পরে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারে অপরাধমূলক লেনদেনে ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে গরমিল তথ্য দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা যাবে না। এতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাবের কেওয়াইসি (গ্রাহকের পরিচিতি) ফরমে দেয়া তথ্যের সঙ্গে মোবাইল সিম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সঙ্গতি থাকতে হবে। এছাড়া ঝুঁকি কমাতে পাঁচ হাজার টাকা বা তার বেশি অঙ্কের লেনদেনে গ্রাহকের ছবি তুলে সংরক্ষণ করতে হবে। তবে অন্যান্য নির্দেশনা ঠিক থাকলেও গ্রাহকের ছবি তোলার নির্দেশনা পরবর্তীতে শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেনের প্রতিটি পর্যায়ে রেকর্ড থাকে। ফলে এ ক্ষেত্রে অনিয়ম কিংবা সন্দেহজনক লেনদেনের ঝুঁকি নেই। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে যাচাইয়ের মাধ্যমে সিমকার্ড নিবন্ধন করার কারণে এ্যাকাউন্টধারী গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত করাও সহজ হয়েছে। কিন্তু এজেন্টের মাধ্যমেই অনিয়মের ঝুঁকি এবং সন্দেহজনক কিংবা অনিয়মের মাধ্যমে লেনদেনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এজেন্টদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও নিজস্ব নিয়মে নজর রাখছে। অনিয়ম পাওয়া গেলে এজেন্টের নিবন্ধন বাতিল করা হচ্ছে।
×