ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোটা সীমান্ত এলাকা ‘আর্মি অপারেশন জোন’ ঘোষণা, আরসার এক মাসের অস্ত্রবিরতি জলে স্থলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত. ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য. ঘোষিত বিদেশী ত্রাণ সহায়তা এখনও পৌঁছেনি

রোহিঙ্গা উচ্ছেদে মাইকিং ॥ চূড়ান্ত অপারেশনে যাচ্ছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা উচ্ছেদে মাইকিং ॥ চূড়ান্ত অপারেশনে যাচ্ছে মিয়ানমার সামরিক  জান্তা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরও ভয়াবহ ও হিংস্র, রুদ্রমূর্তি নিয়ে নামছে। শুরু হচ্ছে ফাইনাল অপারেশন। দেয়া হয়েছে নয়া আল্টিমেটাম। রাখাইন রাজ্যজুড়ে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে অভিযান শুরুর পর এখন সীমানা সন্নিহিত এলাকাকে ‘আর্মি অপারেশন জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। সেনা পরিকল্পনা অনুযায়ী গত শনিবার থেকে রাখাইন রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে মাইকিং। বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) জীপ ও চাইক্যা (রিক্সাজাতীয়) যোগে কিছু রোহিঙ্গা হাতে নিয়ে তাদের দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় এই মাইকিং চালানো হচ্ছে। মাইকিংয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘রোহিঙ্গারা এদেশ ছেড়ে চলে যাও, তোমরা বাঙালী, বাংলাদেশ তোমাদের দেশ।’ এ অবস্থায় রক্তাক্ত জনপদ রাখাইন ১৬ দিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলমান অবস্থায় আবার আরও ভয়ানক পরিস্থিতির উদ্ভব হলো। রোহিঙ্গাশূন্য গ্রামগুলোতে মিয়ানমার বাহিনী লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা যাতে পুনরায় ফিরে আসতে না পারে সে লক্ষ্যেই এ অপতৎপরতা বলে সীমান্তের সূত্রগুলো জানিয়েছে। ওপারে সূত্রগুলো জানিয়েছে, শনি ও রবিবার নতুন করে আরও দুটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা অব্যাহত রয়েছে। ফলে অবশিষ্ট যেসব রোহিঙ্গা দুঃসাহসিকভাবে অবস্থান করছিল তারাও এখন ভিটামাটি ছেড়ে জলে-স্থলে-পাহাড়-জঙ্গল-অরণ্যের পথ ধরে পালাতে শুরু করেছে। সকলের গন্তব্য বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য। বাংলাদেশ সরকারও অঘোষিতভাবে মানবিক কারণে সীমান্ত খোলা রেখেছে। এ দফায় আরও ন্যূনতমপক্ষে একলাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত দুদিনে এসেছে আরও প্রায় একলাখ। ফলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে উখিয়ার বালুখালি এলাকায় দেড় হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরও এক হাজার একর বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। এ স্থানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে সরকারী উদ্যোগে। অপরদিকে, ওপারের বিভিন্ন সূত্র ও আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতায় অবতীর্ণ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এআরএসএ বা আরসা রবিবার থেকে একমাসের জন্য তাদের সশস্ত্র তৎপরতা তথা অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে। আরসার পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে, আবারও সংগ্রামী তৎপরতার নেপথ্যে স্বাধীনতা নয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সকল মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবিতে। আরসা নেতা মোঃ আতাউল্লাহর মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আরসা সদস্যদের নিধনের নামে মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যাকা- অব্যাহত রেখেছে। ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে দেশান্তরি হয়েছে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে হাজার হাজার। এ অবস্থায় মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং জনমত গড়ে ওঠায় তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে সাময়িক অস্ত্রবিরতি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনপদে মানবসৃষ্ট সঙ্কট থেকে উত্তরণে ত্রাণ সহায়তাদানকারী সকল সংস্থার সুবিধার্থে এবং মিয়ানমার বাহিনীর তা-বলীলার পর মৃত্যুপুরী রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে অস্ত্র বিরতির এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এদিকে, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন্ এলাকা থেকে বিশেষ করে মংডু, বুচিদং, রাচিদং শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এদের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ, আহত, বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবিহীন রোহিঙ্গাও রয়েছে। রবিবার নতুন করে আরও ৭ রোহিঙ্গাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ছাড়াও চকরিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া অঞ্চলের হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতেও আহত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা চলছে। এছাড়া টেকনাফ, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় বিভিন্ন মেডিক্যাল টিম রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। পর্যাপ্ত ডাক্তার বা চিকিৎসা সহায়তা কর্মী না থাকায় অনেকেই চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে কাতরাচ্ছে। এছাড়া খাদ্য সঙ্কট, বাসস্থান সঙ্কট তো হয়েছেই। খোলা আকাশের নিচে রয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। মোদ্দা কথায়, প্রশাসনের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। পাশাপাশি ওসব অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দার মাঝেও বড় ধরনের দুর্ভোগ নেমে এসেছে। একদিকে মানবিকতা, অপরদিকে নিজেদের দুর্ভোগ; সব মিলিয়ে এসব অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্নমাত্রার আপদ। আরসার অস্ত্রবিরতি ঘোষণা ॥ রাখাইনে সৃষ্ট মানবিক সঙ্কট উত্তরণে ত্রাণ সহায়তাকারী সংস্থাগুলোকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) রবিবার থেকে একমাসের জন্য অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। গত ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে একযোগে রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়েছে আরসার পক্ষ থেকে। এরপরই শুরু হয় সেনা নেতৃত্বাধীন রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিয়ান। যদিও মিয়ানমার সরকার থেকে বার বার বলা হচ্ছেÑ এ অভিযান বাঙালী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী অভিযান। এ অভিযানে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তা সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ঘটনায় জলেস্থলে ও সাগরপথে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। আশ্রিত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আরসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাখাইনে এবং সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে এবং তাদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর সুবিধার্থে এ অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ঘোষণা সাময়িক। তারা দেখতে চায় মিয়ানমার সরকার তাদের চলমান বর্বরতা ও হিংতা কোন্মুখী হয়। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এবং বিশ্ব সংস্থাগুলো রাখাইনের ঘটনা নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাই তারা পর্যবেক্ষণে রাখছে। রাখাইন ছাড়তে মাইকিং ॥ রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে অবশিষ্ট যেসব রোহিঙ্গা এখনও দুঃসাহসের সঙ্গে রয়েছে তাদের আগামী ১২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারের মধ্যে এলাকা ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়ে মাইকিং শুরু করেছে সামরিক জান্তা । দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এলাকায় এলাকায় মাইকিং করে এ আহ্বান জানানো হচ্ছে। শনিবার বিকেলে শুরু হওয়া মাইকিং রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে মংডু, রাচিদং ও বুচিদং তিনটি শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মিয়ানমার ছাড়ার মাইকিংয়ে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিয়ানমারে অবস্থানকারী সব রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগ করতে হবে। আরাকানের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) তথা আরসা একমাসের জন্য অস্ত্র বিরতি ঘোষণা দেয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষে এ মাইকিং শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামরত আরসার পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে, মানবিক ত্রাণ সহায়তা শুরু করতেই তারা অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গাশূন্য পাড়ায় লাল পতাকা ॥ রাখাইনে যেসব পাড়া আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে সেখানে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাচিদং জেলার ধইনচ্যা পাড়া, বুচিদংয়ের তামাবিল, কইল্যাভাঙ্গা, রাইচং, মংডু জেলার নারিনচং, মগ্নিপাড়া, সিকদারবিল, পেরামপ্রু, নাইছ্যাপুর, শীলখালী, ধুমছেপাড়া, কোয়াংসং ও আদং গ্রামসহ যেসব পল্লী রোহিঙ্গাশূন্য করা হয়েছে, ওসব এলাকায় সেনাবাহিনী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে লাল পতাকা ওড়াছে। পাহারায় রাখা হয়েছে স্থানীয় রাখাইন যুবকদের। যাতে রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে না পারে। ফলে বাধ্য হয়েই বন, জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে যারা লুকিয়েছিল তারাও এখন বাংলাদেশমুখী হয়েছে। স্থলমাইন বিস্ফোরণে আরও ৩ রোহিঙ্গা নিহত ॥ কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্তের মিয়ানমার অংশে স্থলমাইন বিস্ফোরণে ৩ রোহিঙ্গা নিহত ও এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও তিনজন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন রেজু আমতলি ও তুমব্রু সীমান্তে বাংলাদেশ-মিয়ানমার ৩৭-৩৮নং পিলারের মধ্যস্থানে শনিবার রাত ও রবিবার সকালে স্থলমাইন বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটে। অনুপ্রবেশের বিরামহীন স্রোত ॥ রবিবারও দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের বিরামহীন অনুপ্রবেশের স্রোত। বয়স্করাও মাথায় তল্পিতল্পা নিয়ে অনুপ্রবেশ করছে। এর আগে অনুপ্রবেশকারীরা নিজেদের সুবিধাজনকস্থানে বসতি গড়ে তুলছে। পাশাপাশি অসুস্থ হয়ে পড়া রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশুরা মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত চিকিৎসা ক্যাম্প ছাড়াও নতুন আসা রোহিঙ্গা চিকিৎসা প্রার্থীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রেগুলোতেও। গুলিবিদ্ধ অনেক রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা ॥ মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গার মধ্যে এ পর্যন্ত ৮ লাখেরও বেশি এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আগে ছিল ৫ লাখেরও বেশি। গত অক্টোবর থেকে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আরও ৪ লক্ষাধিক। এখন আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জিরো পয়েন্টসহ ওপারের ঝোপ, জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নিয়ে আছে। যৌথ বাহিনীর নজরদারির ফাঁকফোকরে এরা প্রতিদিন সীমান্তমুখী হচ্ছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় কয়েক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখনও সেখানে রয়েছে। সরকারী উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ শুরু ॥ সরকারের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের জন্য ওই আশ্রয়কেন্দ্রে সব ধরনের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ। রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আজ সোমবার থেকে। নিবন্ধন কার্যক্রম প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তত্ত্ব¡াবধানে জেলার উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাস্তার পাশে থাকা, বস্তি তৈরি ও ক্যাম্পে অবস্থানকৃত নতুন রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করবেন তারা। রোহিঙ্গাদের পালানোর পথেও গুলি ॥ মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে রোহিঙ্গা পল্লীগুলো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ায় রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা অব্যাহত রেখেছে। রাজ্যজুড়ে ওরা ছুটছে এদিক-ওদিক। শনিবার রাতে এবং রবিবারও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল। টেকনাফের হ্নীলা, কানজরপাড়া, লেদা, মৌলবি বাজার, খারাংখালী, হোয়াইকং, লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, উলুবনিয়া, উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া, রহমতেরবিল, ধামনখালী, বালুখালী, দরগাবিল, নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুম, কোনাপাড়া, মধ্যমপাড়া, পাথরকাটা, রেজুআমতলী, আছার বাগান, জলাপাইতলী, কলাবাগান, গর্জনবনিয়া, কেউয়াছড়ি, পাথরা ঝিরি, বাইশছাড়ী, আজুখাইয়া ঘাট সীমান্ত দিয়ে রবিবারও হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে অনুপ্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাঁচার আকুতিও শুনছে না। সেনাবাহিনী, নাসাকা ও পুলিশ সদস্য এবং উগ্রপন্থীরাও রোহিঙ্গাদের পালানোর পথে হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে। জনমনে আতঙ্ক ॥ সীমান্তে বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বানের পানির মতো রোহিঙ্গা জনস্রোত জেলাজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এমন সুযোগে তারা যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে পারে। এখন তাদের লাগাম টেনে না ধরলে ভবিষ্যত এ রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উখিয়া টেকনাফ বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ে জঙ্গলে, রাস্তার ধারে ইতোমধ্যে ছোট ছোট শত শত অস্থায়ী বস্তি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। সুযোগ বুঝে কিছু কিছু রোহিঙ্গা বস্তি ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যেও চলে যাচ্ছে। গুলিবিদ্ধ ৯ রোহিঙ্গা চমেকে ॥ রাখাইনের সহিংস ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ৯ নারী-পুরুষ শনিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ৭ পুরুষ ও ২ নারী। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে মোঃ হামিদ হোসাইন (৩২) তাহের হোসাইন (২৫), আবুল কালাম (৩৫), শামসুল আলম (৩৪) ও রশিদ উল্লাহ (২৪), মনসুর রহমান (২৫), করিম উল্লাহ (৪০), ফাতেমা (১৫), মোসাম্মত আজিজার (১১) নাম জানা গেছে। এর ফলে এ পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। এদের প্রত্যেকের অবস্থা গুরুতর বিধায় চিকিৎসা হবে দীর্ঘমেয়াদী। বিত্তবান বহু রোহিঙ্গা পথের ফকির ॥ মিয়ানমারে সামরিক জান্তার সহিংস অভিযানের ফলে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন বিত্তবান। সহায় সম্পদ ভিটেমাটি সবকিছু ফেলে বাংলাদেশে আসার পর তারা আজ পথের ফকির হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এমন অনেকের মধ্যে রয়েছেন হনুফা বেগম। শনিবার এসেছেন তিনি। সঙ্গে এসেছেন স্বামী, শাশুড়ি ও তিন সন্তান। মিযানমার সেনাবাহিনী তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। আরেকজনের নাম আলাউদ্দিন। তিনি বলেছেন, রাখাইনে তার বিপুল পরিমাণ জমি ছিল। তিনিও আজ পথের ভিখারি। মংডুর কালামিয়া বলেছেন, সেখানে তার গ্যারেজ ছিল, বাস ছিল। মোটামুটি ভাল অবস্থানে ছিলেন। আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। সেনা সদস্যরা তার বাড়িঘর, গ্যারেজ সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। তিনিও আজ পথের ভিখারির মতো উদ্বাস্তু জীবনে এসেছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র করবে মিয়ানমার ॥ রাখাইন রাজ্যের গৃহহীন রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমার সরকার আশ্রয় কেন্দ্র করবে বলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে। শনিবার দেশটির সরকারী সংবাদ সংস্থা গ্লোবাল নিউ লাইট এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ১৬ দিন ধরে সামরিক অভিযান চলমানের প্রেক্ষাপটে সরকারীভাবে রোহিঙ্গাদের সহায়তার ঘোষণা এটাই প্রথম। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ২৭ হাজার বৌদ্ধ ও হিন্দু দেশটির আশ্রম ও বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সরকার বলেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটির উত্তর, দক্ষিণ ও রাখাইন রাজ্যের মাংদাওয়ে তিনটি ক্যাম্প করবে। গৃহহীন রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সাহায্য ও চিকিৎসাসেবা দেবেন মিয়ানমার রেডক্রসের কর্মীরা। গত বছরের অক্টোবরে সন্ত্রাসীরা তিনটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালায়। তার পর থেকে রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে চলে আসছে। চেকপোস্ট ॥ রোহিঙ্গারা যাতে উখিয়া টেকনাফের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে না পারে সে জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসন মেরিন ড্রাইভ সড়কে চেকপোস্ট স্থাপন করছে। আজ থেকে ওইসব চেকপোস্টের কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া উখিয়া বাজারে রবিবার থেকে একটি ত্রাণ সংগ্রহ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। ব্যক্তিগত বা সংগঠনের ব্যাপারে কাউকে ত্রাণ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুসারে আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খোলা হিউমেনেটেরিয়ান এসিস্ট্যান্টস টু দ্য মায়ানমার সিটিজেট ইল্লিগেলি মাইগ্রেটেড (রোহিঙ্গা) নামের রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে তাদের সহায়তার অর্থ জমা দিতে হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখায়ও সাহায্য সহায়তা গ্রহণ করা হবে। আয়েবার কর্মসূচী ॥ এদিকে, ইউরোপ প্রবাসীদের সংগঠন আয়েবার পক্ষ থেকে রবিবার বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের পক্ষে কর্মসূচী নেয়া হযেছে। এ কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা। জেনেভাস্থ জাতিসংঘ সদর দফতর ও ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) সদর দফতরের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচীও নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে আজারবাইজান ॥ প্রাণের ভয়ে মায়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে আজারবাইজান সরকার। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা লাখ লাখ সহায় সম্বলহীন বিপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা দিতে জরুরী ভিত্তিতে ১০০ টন খাদ্যসামগ্রী শনিবার আজারবাইজান থেকে সিল্ক ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের বিশেষ কার্গো বিমানে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম এলিয়েভের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা হিসেবে পাঠানো প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের এসব খাদ্যসামগ্রী কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব খাদ্যসামগ্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে খাদ্যসামগ্রীগুলো গ্রহণ করেন আজারবাইজানের কার্গো এয়ারলাইন্স সিল্ক ওয়েস্টের বাংলাদেশ জেনারেল সেলস এজেন্টের (জিএসএ) পরিচালক ও সিইও শেখ বশির আহমেদ মামুন।
×