ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যেন পাখির নরম পালক, ফুলে ফুলে সাদা প্রকৃতি

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

যেন পাখির নরম পালক, ফুলে ফুলে সাদা প্রকৃতি

মোরসালিন মিজান সিরাজদিখান যাচ্ছি। রাজধানী শহর পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলেছে। এভাবে বেশকিছু সময় চলার পর বাঁ দিকে মোড়। এবার গাঁয়ের পথ। সরু রাস্তা। রাস্তার প্রায় সমান্তরালে বয়ে চলেছে ইছামতি নদী। শান্ত নদীর জলে লুটিয়ে পড়েছে বৃক্ষের সবুজ। আর এ সবুজের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল কাশফুল। বার বার দেখা দৃশ্য। এর পরও বাতাসে দুলতে থাকা সাদা কাশফুল দেখে মন কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইছামতির জল ছুঁয়ে থাকা কাশবন স্থলভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। দেখে শেষ করা যায় না। অভিভূত হতে হয় শুধু। অবশ্য শুধু সিরাজদিখানে নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন কাশফুলের সৌন্দর্য দৃশ্যমান হচ্ছে। কারণ আর কিছু নয়। শরতের অবদান। একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা...। প্রিয় ঋতুর চিরচেনা রূপকে ধারণ করেছে সাদা ফুল। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেÑ শরত এসেছে। এভাবে শরত আর কাশফুল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বর্তমানে গ্রামে নদীর ধারে জলাভূমিতে ঘন হয়ে ফুটে আছে কাশফুল। নৌকা করে যাওয়ার সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকার আহা কী আনন্দ! দুরন্ত ছেলেমেয়েরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে বনে ঢুকে পড়ে। কাশের গুচ্ছ সংগ্রহ করে তবেই বাড়ি ফেরে তারা। এদের দিকে তাকিয়েই হয়তো কবিগুরু লিখেছিলেনÑ ‘শরতের মধ্যে শিশুর ভাব। তার, এই-হাসি, এই-কান্না। সেই হাসিকান্নার মধ্যে কার্যকরণের গভীরতা নাই, তাহা এমনি হাল্কাভাবে আসে এবং যায় যে, কোথাও তার পায়ের দাগটুকু পড়ে না, জলের ঢেউয়ের উপরটাতে আলোছায়া ভাইবোনের মতো যেমন কেবলই দুরন্তপনা করে অথচ কোন চিহ্ন রাখে না।’ অবশ্য গ্রামের বয়স্ক লোকদের কথা আলাদা। বড়রা কাশফুলের সৌন্দর্যকে সাধারণ সৌন্দর্য হিসেবেই গ্রহণ করেন। বহু কালের অভ্যস্ত চোখে শরতের প্রকৃতিকে অবলোকন করেন তারা। শহরের কথায় আসা যাক। শহরে কাশবন খুব কমই দেখা যায়। এ কারণেই হয়তো রাজধানীর মানুষ ফুলটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখান। কত আগ্রহ? জানার জন্য একবারের জন্য হলেও দিয়াবাড়ি ঘুরে আসা চাই। হ্যাঁ, শুধু কাশবনের জন্য উত্তরাসংলগ্ন এলাকাটি এখন যারপরনাই বিখ্যাত। সারা বছর সাদা ফুলটি দেখা যায় না। এখন বিস্তীর্ণ খোলা অঞ্চলের প্রায় পুরোটাজুড়ে কাশফুল। প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয় ঠিকানা। কত মানুষ মনের আনন্দে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! কাশফুল আলতো করে জড়িয়ে ধরছেন তন্বী তরুণীরা। ছবি তুলছেন। সেই ছবিতে ভরে উঠছে ফেসবুক। অন্যরাও পরিকল্পনা করছেন কবে সেখানে যাবেন। দল বেঁধে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। পুরো পরিবার নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন অনেকে। ঢাকার পূর্বাচল ও বসুন্ধরাসংলগ্ন ৩০০ ফিট রাস্তার ধারেও উৎসবের আমেজ। দারুণ হৈ হুল্লোড়। হাসিরাশি আনন্দ। সবই কাশবন ঘিরে। শরতের এই দান অব্যাহত থাকবে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। নদীতীরে যে উর্বর পলিমাটি থাকে সেখানে সহজেই বেড়ে ওঠে কাশ। বিভিন্ন জলাভূমি ও চরাঞ্চলে দেখা যায়। শুষ্ক এলাকা পাহাড় এবং এ ধরনের উঁচু জায়গায় স্বতন্ত্র সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হয় কাশবন। কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ঝধপপযধৎঁস ংঢ়ড়হঃধহবঁস. দীর্ঘকাল ধরে এটি বাংলাদেশে আছে। ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ অনেকটা ছনের মতো। গাছ ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চিরল পাতার দুই পাশ বেশ ধারালো। কাশফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম আবার কুশ। পুরাণে কুশের কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুটি দেখতে প্রায় একই রকম। তাই সহজে আলাদা করা যায় না। আলাদা করার দরকারও নেই কোন। সাদা ও রুপালি রঙের কাশফুল ফুটে আছে। সৌন্দর্যটুকু দ্রুত উপভোগ করা চাই শুধু। কারণ আর কদিন পর মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। ফুলটি আর দেখা যাবে না। কবিগুরুর ভাষায় বললে, ‘আমাদের শরতে বিচ্ছেদ-বেদনার ভিতরেও একটা কথা লাগিয়া আছে যে, বারে বারে নূতন করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে বলিয়াই চলিয়া যায়Ñতাই ধরার আঙিনায় আগমনী-গানের আর অন্ত নাই। যে লইয়া যায় সেই আবার ফিরাইয়া আনে। তাই সকল উৎসবের মধ্যে বড়ো উৎসব এই হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়ার উৎসব।’ শরতের এই উৎসব টিকে থাকুক।
×