ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজালাল থেকে পশ্চিমা দেশে সরাসরি কার্গো রফতানির দ্বার খুলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শাহজালাল থেকে পশ্চিমা দেশে সরাসরি কার্গো রফতানির দ্বার খুলছে

আজাদ সুলায়মান ॥ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ইডিএস মেশিন বসানো হয়েছে। এটি চালু করার জন্য সব ধরনের প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন শুধু বাকি ভেলিডেশান করা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একজন ভেলিডেটর এনে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেলেই ঢাকা থেকে সরাসরি পশ্চিমা দেশগুলোতে কার্গো রফতানি করা যাবে। বহুল আলোচিত এই ইডিএস স্থাপন নিয়ে যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা কোম্পানি ও ডিএফটি বেশ চাপ দিয়ে আসছিল। ইডিএস ছাড়া ঢাকা থেকে আকাশ পথে কার্গো পরিবহন নিরাপদ নয়-এমন অজুহাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এমন তুচ্ছ অজুহাতে গত দেড়বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে পণ্যবাহী কার্গো পরিবহনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিষেধাজ্ঞা চলছে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রথমেই যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা কোম্পানিতে তাড়াহুড়ো করে বিনা টেন্ডারে ৭৭ কোটি টাকার কাজ দেয়া হয়। রেড লাইন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করছে এখনও। মূলত তাদের পরামর্শেই শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভবনের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ও যন্ত্রপাতি বসানোর উদ্যোগ নেয় সিভিল এভিয়েশন। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম)। জানা যায়, ইডিএস বসানো হলেও এটা চালু করতে আরও প্রায় মাসখানেক সময় লাগতে পারে। এটা কোন মেশিন কিভাবে ঢাকায় অপারেট করা হবে, যারা করবে তারা কতটুকু প্রশিক্ষিত এ সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একজন ভেলিডেটরকে আমন্ত্রণ জানাবে বিমান। একজন ভেলিডেটর ঢাকায় এসে ইডিএস মেশিন সরেজমিনে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করে একটা সত্যায়িত প্রতিবেদন দাখিল করবেন যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) বিভাগে। ওই প্রতিবেদনে যদি ডিএফটি সন্তুষ্ট হয় তবেই ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গো রফতানির চূড়ান্ত অনুমোদন মিলতে পারে। এ বিবেচনায় এখন সবকিছু নির্ভর করছে ভেলিডেশনের ওপর। এটা যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে ততো তাড়াতাড়ি সরাসরি কার্গো রফতানি সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী জানান, যে ইডিএস মেশিন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মরফু কোম্পানি থেকে আনা হয়েছে- তা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও নির্ভরযোগ্য। এটি পৃৃথিবীর অনেক উন্নত দেশগুলোর বিমানবন্দরে চালু করা হয়েছে। এটি নির্ভুলভাবে কার্গোর স্বচ্ছতা যাচাই করতে সক্ষম। এই মেশিনের মাধ্যমেই প্রতিটি কার্গোর পকেট পরীক্ষা করা হবে। এতে যদি বিন্দুুমাত্র আপত্তিকর কোন পদার্থ থাকে সেটাও তা ধরতে সক্ষম। ইডিএস দ্বারা পরীক্ষিত কোন মালামাল শতভাগ নিরাপদ বলেই বিবেচনা করা হয়। সেজন্য এখন এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় অর্জন। জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রফতানি কার্গো ভিলেজের ভেতর বসানো এই ইডিএস দিয়ে প্রতিটি কার্গো স্ক্যানিং করা হবে। এটি ফাঁকি দিয়ে কার্গোর ভেতরে কোন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য বা অস্ত্র পাচার করা সম্ভব নয়। এই মেশিনে কাজ করার জন্য ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিভিল এভিয়েশনের ৬ জন এবং দেশে আরও ৪৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারাই এটা অপারেট করবেন। বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত এই ইডিএস স্থাপনের মধ্যে দিয়ে কার্গো পরিবহনে পশ্চিমা দেশগুলোতে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেবিচকের সদস্য (পরিচালন ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর এ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন ইডিএস, ইডিটি স্থাপনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ইইউ রাষ্ট্রদূত শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো কমপ্লেক্স সরেজমিন পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি লুফতানসা সিকিউরিটি টিম বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছে। তারাও সন্তোষ প্রকাশ করেছে। একইভাবে ইতিহাদ কার্গোর একটি নিরাপত্তা দলের পরিদর্শনেও শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের পরিচালন কার্যক্রম সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিবেদন এসেছে। আশা করা যায়, শীঘ্রই পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। রেড লাইনের পরামর্শে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বেশকিছু যন্ত্র কেনা হয়েছে। এসব যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে উড়োজাহাজের হোল্ডে রাখার মতো ভারি ব্যাগ তল্লাশিতে আটটি ডুয়াল ভিউ এক্স-রে স্ক্যানিং মেশিন, হ্যান্ড ব্যাগ তল্লাশির জন্য ১৪টি ডুয়াল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন, ছয়টি লিকুইড এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (এলইডিএস), নয়টি আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং সিস্টেম (ইউভিএসএস), চারটি ফ্যাপ বেরিয়ার গেট উইথ কার্ড রিডার, পাঁচটি বেরিয়ার গেট উইথ আরএফআইডি কার্ড রিডার, দুটি ইডিএস ও চারটি ইটিডি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেবিচকের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এসব যন্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, কার্গোর পাশাপাশি যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি, তরল বিস্ফোরক শনাক্তকরণ এবং যানবাহন তল্লাশির জন্যও বসানো হচ্ছে পৃথক সরঞ্জামাদি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় এর আগে গত বছরের ৮ মার্চ বিশেষ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। দেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে জরুরী সরঞ্জাম সরবরাহ ও সংস্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় মোট ৮৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ইডিএস কেনা হয়েছে ৩৫ কোটি টাকারও বেশি দামে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, হঠাৎ অপ্রতুল নিরাপত্তা ও বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশের কারণ দেখিয়ে গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশের সঙ্গে আকাশপথে সরাসরি কার্গো (বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য পরিবহন) পরিবহন স্থগিত করে যুক্তরাজ্য। ওই দিন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঢাকায় সরাসরি ফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার দু’সপ্তাহের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে ২১ মার্চ পরামর্শ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও জনবল প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাজ্যের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রেড লাইন এ্যাসিউরড সিকিউরিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে বাধ্য হয় সিভিল এভিয়েশন।
×