ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফাইল চালাচালি আর নক্সা তৈরিতে ঝুলে আছে প্রথম উড়াল ফুটপাথ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ফাইল চালাচালি আর নক্সা তৈরিতে ঝুলে আছে প্রথম উড়াল ফুটপাথ

মশিউর রহমান ॥ ঘোষণা আর পরিকল্পনাতেই আটকে আছে দেশের প্রথম এলিভেটেড ওয়াকওয়ে বা উড়াল ফুটপাথ নির্মাণকাজ। রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাথে পথচারীদের স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করতে ও ট্রাফিক সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। নাগরিক কষ্ট লাঘবে এ উদ্যোগ নিলেও ঘোষণার প্রায় এক বছরেও এর কোন উন্নতি চোখে পড়ছে না। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে এটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও অর্থের সংস্থানও আজও মেলেনি বলে জানা গেছে। ডিএসসিসির সীমানায় গুলিস্তানের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর রাজধানীর অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে মতিঝিল ও নিউমার্কেটে একই প্রযুক্তির উড়াল ফুটপাথ নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও গুলিস্তানের স্থাপনাটি নির্মাণ না হওয়ায় অপর দুটির কাজ মুখথুবড়ে পড়েছে। সংস্থাটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এলিভেটেড ওয়াকওয়েটির নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু কাজ শুরুর নির্ধারিত সময়ের আট মাস পেরিয়ে গেলেও বর্তমানে এটি পরিকল্পনা, নক্সা তৈরির কাজ ও কনসালটেন্ট পর্যায়েই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে ডিএসসিসির প্রকৌশল শাখা জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। এছাড়া কবে নাগাদ এটির নির্মাণকাজ শুরু হবে বা শেষ হবে তার কোন সময়ই বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, প্রায় এক কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে অত্যাধুনিক এ উড়ালপথটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১শ’ ১৫ কোটি টাকা। এতে একই সঙ্গে এস্কেলেটর ও সাধারণ সিঁড়ি থাকবে, যাতে চলাচলকারীরা হেঁটে অথবা এস্কেলেটর উভয় পদ্ধতিই ব্যবহার করতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে নাগরিকদের উন্নত সুবিধার কথা চিন্তা করে রাজধানীতে বসবাসকারী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নাগরিকদের ফুটপাথে চলাচলের সুবিধার্থে হংকং শহরের আদলে তৈরির জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। অপরদিকে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ গুলিস্তানে উড়াল ফুটপাথ তৈরির ঘোষণা দেয়ার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যানে এলিভেটেড ওয়াকওয়ের মতো প্রকল্পটি না থাকায় নগর বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কিছুটা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, ব্যয়বহুল প্রকল্প সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন না করা গেলে এটি নির্মাণের প্রকৃত উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। তাই সব দিক বিবেচনা করে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে এ পাইলট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা উচিত। বর্তমান জরিপমতে, রাজধানীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ যাতায়াত করে হেঁটে, ফুটপাথ দিয়ে। রাজধানীর মোট ট্রিপের (যাতায়াত) প্রায় ১৮ শতাংশ হয় হেঁটে। রাজউকের তৈরি ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে মোট ট্রিপ হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয় হেঁটে। নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য রাজধানীতে ছোট-বড় মোট ৯০টি ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে। এগুলো নির্মাণে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরুর পর এটির সঠিক বাস্তবায়ন নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে এটির বাস্তবায়নে আরও গবেষণার পরামর্শ দেয়। প্রকল্পটির লাভ-ক্ষতি সার্বিক দিক ভেবে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলা হয়। সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে এটি চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে ডিপিপি আকারে তা পাস করার জন্য একেনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য পাঠানোর কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত নক্সাই চূড়ান্ত করেনি ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি প্রকল্পটি চূড়ান্ত করার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু ডিএসসিসি জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তেমন কোন গুরুত্বই দিচ্ছে না। ফলে পরিকল্পনা গ্রহণের এক বছরেও ফাইল চালাচালি আর ওয়াকওয়ের নক্সা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও হাঁটার পথ বাড়ছে না। এছাড়া নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানের ফুটপাথগুলো অনেকটা সরু হয়ে যাওয়ায় কোন কোন স্থানে তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফুটপাথগুলোর মধ্যে কোথাও সরু আবার কোথাও চওড়া করে তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেই অনেক স্থানে নাগরিকদের চলাচল করতে হচ্ছে। অনেক স্থানে ফুটপাথ না থাকায় বা ফুটপাথ থাকলেও তা অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় চলাচলে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ডিএসসিসি তার সীমানায় অতিব্যস্ত স্থান হিসেবে গুলিস্তানকেই উড়াল ফুটপাথ তৈরির স্থান হিসেবে বেছে নেয়। এরপর প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষে রাজধানীর জনাকীর্ণ স্থান হিসেবে মতিঝিল ও নিউমার্কেটের ফুটপাথে একই প্রযুক্তির উড়াল ফুটপাথ তৈরির পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এসব ওয়াকওয়ে পথচারীদের চলাচলে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ উড়াল ওয়াকওয়ে ব্যবহার করে জনগণ কম সময়ে ও নির্বিঘেœ গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকায় হেঁটে চলাচল করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেব কনসালটেন্ট নামের এক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পের নক্সা প্রণয়ন করেছে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ উড়াল ফুটপাথটির দৈর্ঘ্য ধরা হয় এক হাজার ১শ’ ২০ মিটার। দীর্ঘ এ এলিভেটেড ওয়াকওয়েতে থাকবে ১০টি এস্কেলেটর ও ১৬টি সিঁড়ি। সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে এটি নির্মাণে ১শ’ ১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প সূত্র জানায়, রাজধানীর অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে সচিবালয়ের সামনে থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে বায়তুল মোকাররম-গুলিস্তান-আহাদ পুলিশ বক্স থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত এ এলিভেটেড ওয়াকওয়েটি নির্মাণ করা হবে। ডিএসসিসির এ পাইলট প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে পরবর্তীতে নিউমার্কেট, সদরঘাট ও মতিঝিলেও এ ধরনের এলিভেটেড ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্টিলের তৈরি অনেক ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি ছাড়া বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কাউকে সেগুলো ব্যবহার করতে দেখা যায় না। অনেক স্থানে বাধ্য হয়ে নাগরিকগণ এসব ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ লোকই এসব ব্রিজ ব্যবহারের পরিবর্তে রাস্তার ওপর দিয়ে চলাফেরা করেন। এর ফলে প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনার শিকার হন অনেকেই। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বনানী ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের ফুটওভার ব্রিজে বিদ্যুতচালিত চলন্ত সিঁড়ির ওভারব্রিজ তৈরি করা হয়। তবে রাজধানীবাসীর প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত কম। ডিএসসিসিতে এ রকম কোনো ফুট ওভারব্রিজে আজ পর্যন্ত চলন্ত সিঁড়ি সংযোজন করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরাজি শাহাবুদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, গুলিস্তান এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার পথচারীর নির্বিঘেœ চলাচলের সুবিধার্থে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ দেশে প্রথমবারের মতো এলিভেটেড ওয়াকওয়ে বা উড়াল ফুটপাথ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বর্তমানে প্রকল্পটির কাজ ধীরগতিতে চলছে স্বীকার করে তিনি বলেন, প্রকল্পটির নক্সা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। নক্সা ঠিক করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। একনেক অনুমোদন দিলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা পরবর্তীতে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করব। তবে যেহেতু প্রকল্পটি এখনও কনসালটেন্টের কাছে রয়েছে তাই বিভিন্ন সমস্যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির কাজ অতিদ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে বলা যাচ্ছে না।
×