ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অক্ষর যোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণ কৌশল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অক্ষর যোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণ কৌশল

মোরসালিন মিজান ॥ আধুনিক যুগ। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কাল। কম্পিউটারে যা খুশি যত খুশি লেখা যায়। ছেপে প্রকাশ করার জন্য আছে লেটেস্ট মডেলের যন্ত্রপাতি। আজকের দিনে তাই পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন হয় না। তবে ইতিহাস চেতনা যাদের প্রবল তাদের জন্য অতীত পাঠ ও অনুসন্ধান জরুরী। একইসঙ্গে আনন্দের। হয়ত তাই প্রথম দিনই জাতীয় জাদুঘর আয়োজিত প্রদর্শনীটি কৌতূহল নিয়ে ঘুরে দেখছিলেন দর্শনার্থীরা। বিশেষ এই প্রদর্শনীর শিরোনামÑ অক্ষরযোজনার মাধ্যমে বাংলার প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রকৌশল। শিরোনামই বলে দেয় স্বর্ণালী দিনের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ভুলে যাওয়া ঐতিহ্য তুলে ধরার প্রয়াস। লেটারপ্রেস যুগের উপস্থাপনা। মূল প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয়েছে জাদুঘরের লবিতে। অল্প জায়গা। ছোট পরিসর। তবে মুদ্রণশিল্পের ধারাবাহিক ইতিহাস ও লিখন পদ্ধতির বিবর্তন সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায় এখান থেকে। বিলুপ্ত প্রায় ট্রেডল মেশিন, এর যন্ত্রপাতি, সীসার অক্ষর, অক্ষর যোজনার মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ব্লক, লেটারপ্রেসে ছাপা বই, বইয়ের প্রচ্ছদÑ কী নেই প্রদর্শনীতে! সব মিলিয়ে ইতিহাসটিকে সামনে আনার চেষ্টা। দৃশ্যমান করার প্রয়াস। প্রথমেই চোখ যায় কাঠের একটি বাক্সের দিকে। হা করে থাকা বিশাল বাক্সে ৪৫৬টি পকেট। প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা অক্ষর। সীসার তৈরি বর্ণমালা থেকে প্রয়োজনমতো অক্ষর তুলে নিয়ে পাশাপাশি সাজাচ্ছিলেন রফিকুল ইসলাম। অবাক কা- এই যে, কোন ধরনের খোঁজাখুঁজি করতে হচ্ছিল না তাকে। কী করে সম্ভব? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সাল পর্যন্ত এটা করেই খেয়েছি। এখন অন্য পেশা। তবে কাজটা ভুলে যাইনি।’ অনেকদিন পর এ কাজ করতে গিয়ে রোমাঞ্চিত বলেই মনে হয় তাকে। দাঁত বাঁধানোর মতো করে অক্ষরগুলোকে মুহূর্তেই বেঁধে ফেলছিলেন। অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর পাশাপাশি বসে বাক্য গঠন করছিল। বাক্য গঠনের পর সেগুলো বিন্যস্ত অবস্থায় চলে যায় প্রেসে। প্রেসে মানে, ট্রেডল মেশিনে। যশোর থেকে খুঁজে আনা হয়েছে দুর্লভ এই মেশিন। ট্রেডল মেশিনের কথা একটু বলা যাক, মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। শতাধিক বছর আগে ছাপার কাজে ট্রেডল মেশিনই ছিল একমাত্র ভরসা। পত্রিকা, সাহিত্যের কাগজ, বই, গেজেট ছাপাসহ প্রায় সব ধরনের মুদ্রণ কাজ হতো এ মেশিনে। ছাপার প্রক্রিয়াটি কেমন ছিল? দর্শনার্থীদের জানাতে ঐতিহ্যবাহী ট্রেডল মেশিন চালিয়ে দেখানো হচ্ছে জাদুঘরের লবিতে। চালানোর কাজটি করছেন গিয়াস উদ্দীন। ঢাকারই একটি ছাপাখানার কর্মচারী তিনি। বললেন, এখন তো সব কম্পিউটারে হয়। আমরাও নতুন মেশিনে কাজ করি। নতুন মেশিনে প্রোডাকশন অনেক বেশি। তার কথার মধ্য দিয়ে লেটার প্রেস যুগের অবসানের একটি অনিবার্য কারণ সম্পর্কে জানা যায়। কথা বলতে বলতে মেশিনের প্যাডেলের মতো জায়গায় পা রেখে চাপ দেন তিনি। দিতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে বড় চাকাটি ঘুরতে শুরু করে। এই চাকার সঙ্গে যুক্ত অপেক্ষাকৃত ছোট চাকাটি ঘুরে একইসঙ্গে। এভাবে একত্রে কাজ শুরু করে সব কলকব্জা। মেশিনের সামনের অংশে কালি মওজুদ করে রাখা। চাকা ঘুরলে সেখান থেকে তরল গড়িয়ে নিচের গোলাকার পাতে পড়তে থাকে। এ অবস্থায় রুটি তৈরির বেলুনের মতো সরু দুটি কাঠির গায়ে কালি মেখে নিচে নেমে যায়। এ দুটোর মাধ্যমে কালি স্থানান্তরিত হয় সীসার ব্লকে। কালি মাখা ব্লক বিছিয়ে রাখা সাদা কাগজের গায়ে ছাপ দিয়ে যায়। অমনি দৃশ্যমান হয় লেখা। এখান থেকে কুসুমকুমারী দাশের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি ছাপিয়ে দেখানো হচ্ছে দর্শনার্থীদের। প্রদর্শনীটিকে সাদামাটা হতে দেয়নি লেটার প্রেস যুগের নানা নিদর্শন। এসব নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে কয়েকটি গ্ল্যাসশোকেস। একটিতে ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার সংখ্যা। সেই ১৯০০ সালে ঢাকা থেকে ট্রেডল মেশিনে ছাপা হতো বিখ্যাত এই সাপ্তাহিক। পাশের একটি শোকেসে জিংক ব্লক এবং এই ব্লক ব্যবহার করে ছাপানো বইয়ের প্রচ্ছদ। অন্য শোকেসগুলোতে রাবার ও পিতলের ব্লক। আছে চারটি লাইনো ব্লকের উপস্থাপনা। মুদ্রণকাজে ব্যবহৃত কালিও বাদ যায়নি। এসবের পাশাপাশি দেয়ালে ছবির সাহায্যে রেখার সাহায্যে মুদ্রণশিল্পের ধারাবাহিক ইতিহাস ও লিপির বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শনীতে সীসার তৈরি অক্ষর হাতে নিয়ে দেখারও সুযোগ রাখা হয়েছে। একটি টেবিলে অনেকগুলো প্লাস্টিকের কৌটো। সবকটিতে মানুষের মাড়ি থেকে খসে পড়া দাঁতের মতো বস্তু। কোন একটিতে রং মাখিয়ে সাদা কাগজে ছাপ দিতেই অক্ষর দৃশ্যমান হয়। দর্শনার্থীরা এগুলো ব্যবহার করে নিজের নাম ইত্যাদি লিখছিলেন। পুরনোকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ উপভোগ করার মতো বৈকি! এর আগে শনিবার সকালে প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচনা করেন সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, লেখক সাংবাদিক আবুল মোমেন, আলী ইমাম, মুহম্মদ জাহাঙ্গীর প্রমুখ। জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। বক্তাদের তালিকা দেখে প্রাথমিকভাবে অনেকেই গতানুগতিক আলোচনার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে তেমনটি হয়নি। বরং লেটার প্রেস ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ইতিহাস ওঠে এসেছে আবেগঘন উচ্চারণে। মুদ্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য জেনে চমকিত হতে হয়েছে। এদিন বক্তারা বলেন, সমকালীন সভ্যতাকে ধারণ করার জন্য যে সমস্ত উপাদান এখনো টিকে আছে সেগুলোর অন্যতম একটি মুদ্রণযন্ত্র। ট্রেডল মেশিন, গেলি, নিউজ প্রিন্ট ভিজিয়ে প্রুফ দেখাÑ এসব কষ্টসাধ্য কাজগুলোর কথা উত্তরসূরিদের জানা প্রয়োজন। তারা বলেন, সভ্যতার সূত্রপাত ঘটেছিল লিপির মধ্য দিয়ে। লিপি থেকে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৮ শতকের মধ্য ভাগে ভুরুঙ্গামারীতে লেটার প্রেস চালু হয়। ১৮৪০ সালে বর্ণ পরিচয় ছাপা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যাণে। বাংলা টাইপোগ্রাফী দৃঢ়তা পায়। বাংলা টাইপের সুশোভন রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে জানানো হয়। বক্তারা বলেন, কলকাতায় সীমিত পরিসরে যে রেনেসাঁ ঘটেছিল তার পেছনে মুদ্রণ শিল্পের একটি বড় ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে ৫০ এর দশক থেকে ৬০ এর দশকে যে সাংস্কৃতিক জাগারণ ঘটে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লেটার প্রেস। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ছাপার ইতিহাসটিও ওঠে আসে আলোচনায়। এর আগে প্রামাণ্যচিত্রে মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। সব মিলিয়ে বেশ লাগে।
×