ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নজরদারিতে রোহিঙ্গারা-

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

নজরদারিতে রোহিঙ্গারা-

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে অবস্থানকারী ও নতুন করে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের ওপর কড়া নজরদারি চলছে। স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও জঙ্গী-সন্ত্রাসী ঢুকতে না পারে এজন্য নজরদারি অব্যাহত আছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে দেশী ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলো দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এমন আশঙ্কা মাথায় রেখেই রোহিঙ্গাদের ওপর বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কোন গোষ্ঠী যাতে কাজে লাগাতে না পারে এজন্য সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে। শনিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে নব্য জেএমবির দুই জঙ্গী গ্রেফতার উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানালেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, তারাও সকল গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করছেন। সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে। আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাতে মাদক, অস্ত্র, গোলাবারুদ, জঙ্গী-সন্ত্রাসী প্রবেশ করতে না পারে এজন্য সরকার কড়া নির্দেশনা জারি করেছে। এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন গোষ্ঠী এককভাবে বা যৌথভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই তারা রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করছেন। কোন গোষ্ঠী যাতে এমন সুযোগ কাজে লাগাতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে নোয়াখালীতেও এক জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাদক, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও জঙ্গী-সন্ত্রাসী প্রবেশ করতে পারে। সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জাতিগত দাঙ্গাসহ নানা নির্যাতনের কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বসবাস করছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়াসহ কিছু জায়গায় তাদের বসবাস। বর্তমানে দেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাত লাখের কাছাকাছি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। কারণ জঙ্গী ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে এদের যোগাযোগ থাকার নানা তথ্য বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সারাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছিল। নির্যাতিত মুসলমান হিসেবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আগাগোড়াই ক্ষোভ রয়েছে। তারা আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) নামের একটি সংগঠন গঠন করে। এই সংগঠনের সঙ্গে ১৯৯৫ সাল থেকেই সখ্য রয়েছে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গী সংগঠন হুজি প্রধান মুফতি হান্নানের। হুজির প্রায় সকলেই আফগান ফেরত যোদ্ধা। এসব যোদ্ধা আরএসও-র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কক্সবাজারের গহিন জঙ্গলে যৌথভাবে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত। এদের সঙ্গে পরবর্তীতে জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনও যোগ দেয়। এমন তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ কক্সবাজারের উখিয়ায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণরত অবস্থায় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও রোহিঙ্গার সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহসহ হুজির ৪০ সদস্য বিপুল পরিমাণ ভারি অস্ত্র, গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের যাবজ্জীবন সাজা হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নিলে আসামিদের জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন বিএনপি-জামায়াতের এক সাবেক আইনমন্ত্রী এবং জামায়াতের প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার কোরবান আলী। আর অভিযান চালানোর অপরাধে কক্সবাজারের উখিয়া সার্কেলের তৎকালীন এএসপি এন কে পালিতকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গ্রেফতারকৃত সেলিমের সঙ্গে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আবু জান্দাল, ভারতের তিহার জেলে বন্দী সহোদর মুরসালিন ও মুত্তাকিন এবং ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গী নেতা গ্রেফতারকৃত ওবায়দুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহ, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা আমির রেজা খান, খুররম খৈয়ামসহ বহু জঙ্গীর সখ্য ছিল। দেশীয় জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে হুজি ও জেএমবি সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করত। সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। দীর্ঘদিন ওই এলাকায় থাকায় স্থানীয় দুই সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শাহজালাল ও মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এই দুই সংসদ সদস্য সহোদর। এদের একজন জামায়াতের অপরজন বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন। তাদের সহোদর বোন বিয়ে করে সেলিম। সেলিমকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে জামিনে মুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে সেলিমকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে সেলিম জাপানে রয়েছে বলে পুলিশের ইন্টারপোল সূত্রে জানা গেছে। সেলিমের তৎপরতা এখানেই শেষ নয়। সেলিম একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনার অন্যতম নেপথ্য কারিগর। সিরিজ বোমা হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের সিংহভাগ সরবরাহ করেছিল সেলিম। সেলিমের সঙ্গে জেএমবির যোগাযোগ ছিল। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। নিজামীর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তনের অনেক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিবের যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগের প্রেক্ষিতেই পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গালিবের ভাগ্নে মোহাম্মদ সালাফিকে শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী তার নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রামের জিয়া সারকারখানায় স্টোর কিপারের চাকরি দেন। সালাফি ছিলেন মূলত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সক্রিয় সদস্য। আর জেএমবি মূলত জামায়াতের বি টিম। শিল্পমন্ত্রী নিজামীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা অবস্থায়ই চট্টগ্রামের জিয়া সার কারখানার ঘাটেই পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম দশ ট্রাকের অস্ত্রের বিশাল চালান খালাস হয়। সালাফি চাকরি নেয়ার পর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সার কারখানা থেকে ভুয়া ভাউচারে ১১শ’ ৮২ টন রক সালফার সরিয়ে ফেলেন। রক সালফার সার ও বিস্ফোরক তৈরির অন্যতম রাসায়নিক পদার্থ। রক সালফার চুরির ঘটনায় পরবর্তীতে তোলপাড় হলেও নিজামীর প্রভাবের কারণে হালে পানি পায়নি। পুরো বিষয়টি কয়েক দফায় আলোচনার পর ধামাচাপা পড়ে যায়। এসব রক সালফার নিয়ে জমা করা হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আহলে হাদিস মসজিদে। মোহাম্মদ সেলিম মসজিদের ভেতরেই সেই রক সালফার ছোট ছোট কাঠের বাক্সে ভরা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা জেএমবির সামরিক শাখার কাছে পাঠায়। সেই রক সালফারের তৈরি বোমা দিয়েই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) বোমা হামলা চালিয়েছিল জেএমবি। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ মে জেএমবির আমির জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদেও এমন তথ্য নিশ্চিত করেন। সাইদুর রহমান জানান, জেএমবি নিষিদ্ধ হওয়ার পর এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে টনে টনে রক সালফার পানিতে ফেলে নষ্ট করা হয়েছে। দেশের দুর্গম জেলায় অবস্থিত জেএমবির সামরিক শাখার কাছে এখনও অনেক রক সালফার মজুদ রয়েছে।
×