ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ঢলে পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ঢলে পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে

হাসান নাসির, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রেহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। শক্ত-সামর্থ্য যুবকের সংখ্যা সেই তুলনায় অনেক কম। বাবা-মা এবং স্ত্রী- সন্তানদের এপারে পাঠিয়ে ওপারে কী করছে তারা? এমন প্রশ্নও অনেকের মুখে। তবে যারা এসেছেন তাদের চেহারায় কেবলই প্রাণে বাঁচার আকুতি। তারা এখানেই থেকে যেতে চান নিজভূমে নিরাপদ একটি অবস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত। এদিকে স্রোতের মতো আসা এই শরণার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে শুরু“ করায় উদ্বিগ্ন কক্সবাজারবাসী। দেশে পর্যটকদের প্রধান গন্তব্য কক্সবাজার শহরের অলিগলিতে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। হাত পাতছে বিভিন্ন দোকান এবং সাধারণ মানুষের কাছে। প্রশ্ন করলেই জানা যায়, এরা রোহিঙ্গা। এমতাবস্থায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে অধিবাসীদের। ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা উপস্থিতি পর্যটনশিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন উৎকণ্ঠাও দেখা দিয়েছে। উখিয়ার কুতুপালং বাজারে অনেকের ভিড়ে তিন সন্তান নিয়ে হাঁটছিলেন আনুমানিক ২৬ বছরের নারী জমিলা বেগম। সন্তানদের বয়স ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর। কোলের সন্তানটি ছেলে, বাকি দু’জন মেয়ে। স্বামী আসেনি কেন, এই প্রশ্নের জবাবে জানায়, সেখানে রয়ে গেছেন বাড়িঘর দেখাশোনার জন্য। কিন্তু বাড়ি তো পুড়িয়ে দিয়েছে, দেখা শোনার কী আছে? জানতে চাইলে বলেন, দুটো গরু এবং তিনটি ছাগল আছে। সেগুলোর কিছু করতে পারলে চলে আসবে। খদিজা বেগম (৫০) এসেছেন পালংখালি সীমান্ত দিয়ে। তিনি ছয় সন্তানের জননী। চার মেয়ে, দুই ছেলে। সঙ্গে আছেন স্বামী এবং পাঁচ সন্তান। বড় ছেলেটি আসেনি। বয়স প্রায় ৩০ বছর। সে কেন আসেনি, জানতে চাইলে বলেন, ওরা কয়েকজন হোঁয়াইজ্যা (সমবয়সী সঙ্গী) আছে। তারা কেউ আসেনি। তারা কি সেখানে যুদ্ধ করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে নাসূচক জবাব দেন এই মহিলা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের প্রধান দাবি এখন নাগরিকত্ব এবং সমান সুবিধা নিয়ে রাখাইন প্রদেশে বসবাস করার অধিকার। স্বাধীনতার দাবি নয়। সেই দাবি একদা থাকলেও এখন তারা নমনীয়। কিন্তু সশস্ত্র কিছু সংগঠন যে সক্রিয় আছে, তা তারা অস্বীকার করছেন না। তবে অনুপ্রবেশকারীদের জোরালো দাবি হলো, তারা ওসবের মধ্যে নেই। নাগরিকত্ব চান, ভোটের অধিকার চান, মর্যাদা চান এবং সমান অধিকার নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে চান। সীমান্ত শহর টেকনাফে গিয়ে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের ঢল। সেখান থেকে ট্রাকে বোঝাই হয়ে তারা আসছে কুতুপালং ও বালুখালী এলাকায়। কারণ, এই দুই জায়গায় চলছে ত্রাণ তৎপরতা। তাছাড়া এখানে অনেক বড়সড় রিফিউজি ক্যাম্পও রয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা এবং সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা আছে। তবে অনেকেই ফাঁক গলে চলে আসছে কক্সবাজার শহরেও। এরা মূলত তারাই, যাদের পরিচিত লোক আগে থেকেই রয়েছে। সীমান্ত শহর টেকনাফের বাস কাউন্টারগুলোতে অসম্ভব ভিড়। কক্সবাজারমুখী বাসের একটি টিকেট পাওয়া খুবই কষ্টকর। যে পরিমাণ যাত্রী, সেই পরিমাণ ট্রান্সপোর্ট নেই। ফলে ভাড়াও বেড়ে গেছে। লোকাল গণপরিবহনের ভাড়া হয়েছে দ্বিগুণ। টেকনাফের ‘সরাসরি স্পেশাল সার্ভিস’ কাউন্টারে পরিলক্ষিত হয় দীর্ঘ লাইন, হৈচৈ এবং টিকেটের জন্য ধাক্কাধাক্কি। অনেক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট মিলছে না। এদর একটি বিরাট অংশ রোহিঙ্গা হতে পারে, এমনই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, বাসের টিকেট বিক্রি হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের মরিচ্যা এলাকায় রয়েছে বিজিবির একটি চেকপোস্ট। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করছেন শহরমুখী স্রোত থামাতে। সেখানে যাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচাই করা হয়। মূলত পরখ করা হয় বাসে কোন রোহিঙ্গা যাত্রী আছে কি না। প্রশ্নের জবাবে ঠিকানা, জীবিকা এবং কর্মস্থল সংক্রান্ত তথ্যে অসঙ্গতি পাওয়া গেলেই নামিয়ে দেয়া হয়। তারপরও ওরা এসে পড়ছে। বিশেষ করে আগে থেকেই কক্সবাজার কিংবা বাংলাদেশের কোন ঠিকানায় যাদের লোক আছে, তারা ঠিকই ঢুকে যাচ্ছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় সীমাবদ্ধ করে রাখাটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, সংখ্যায় তারা হাজার নয়, লাখ লাখ। কক্সবাজার বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন স্পট। সামনেই শুকনো মওসুম। মাস দুয়েক পরেই শুরু হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আগমন। আসবে বিদেশী পর্যটকও। ভরা এই মওসুমের অপেক্ষায় থাকে পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাড়ে চার শতাধিক হোটেল এবং শত শত প্রতিষ্ঠান। কক্সবাজারের যানবাহন চালক, দোকানপাট এবং সাধারণ মানুষের জীবিকার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পর্যটন। সঙ্গত কারণেই অধিবাসীরা শহরটিকে পরিপাটি এবং ঝামেলাহীন দেখতে চান। রোহিঙ্গা স্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পর্যটন শহরে।
×