ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্প কেন অনুপযুক্ত

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্প কেন অনুপযুক্ত

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা তাকে সমর্থন করার পক্ষে দুটো যুক্তি প্রদর্শন করে থাকে। এক. তিনি একজন ব্যবসায়ী যিনি রাষ্ট্রের বাহুল্য খরচ খর্ব করতে পারবেন এবং দুই. তিনি বাম ঘেঁষা এস্টাবলিশমেন্ট এলিটদের রাজনৈতিকভাবে সঠিক অলঙ্ঘনীয় বিধানাবলী ভেঙ্গে তছনছ করে আমেরিকাকে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই এই যুক্তিগুলো খেয়াল-খুশি ভাবনা বলে প্রতিভাত হয়। ১৫ আগস্ট নিউইয়র্কে ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনের পর সেই যুক্তিগুলোর অস্তিত্ব একেবারেই লোপ পেয়ে গেছে। ১৫ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ক’দিন আগে ভার্জিনিয়ার শার্লোটসভিলের সহিংসতা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। ঘটনা সম্পর্কে এ নিয়ে তিনি তৃতীয়বার মুখ খুললেন। কিন্তু এবারের বক্তব্যে তিনি আগের দু’দফা বক্তব্য থেকে সরে আসেন। আগে তিনি সহিংসতার জন্য শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি নিন্দাজ্ঞানের ব্যাপারটা এড়িয়ে যান এবং আগের দু’বারের মতো আবারও জোর দিয়ে বলেন যে সহিংসতার জন্য দু’পক্ষই দায়ী। তবে কোন পক্ষ তার হৃদয়ের কাছাকাছি সে সম্পর্কে তিনি সংশয়ের কোন অবকাশ রাখেননি। ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী নন। তিনি নব্য নাৎসিদের পুনরায় সমালোচনার কারণ এবং হিথার হেয়ারের হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তার পরও তার বক্তব্যের মধ্যে আমেরিকানদের জন্য এক বিপজ্জনক বার্তা রয়ে গেছে। আমেরিকান রিপাবলিকের ত্রাণ কর্তা হওয়া তো দূরের কথা বরং দেশটির প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দিক দিয়ে অদক্ষ, নৈতিক দিক দিয়ে শূন্য গর্ভ এবং মনমানসিকতার দিক দিয়ে এই পদের জন্য অনুপযুক্ত। তার অদক্ষতার প্রসাদ দিয়েই শুরু করা যাক। গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প রাজনৈতিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন যা ওই শ্রেণীর বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছিল। অথচ ক’দিন আগে সহজতম রাজনৈতিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। নাৎসিবাদকে ধিক্কার দেয়ার একটা উপায় পেয়েছিলেন। সেটা কাজে লাগাতে পারেননি শার্লোটসভিলের সহিংসতার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি দ্ব্যর্থবোধক শব্দের দ্বারা নানা বাকচাতুরি করলেন। অথচ প্রকৃত অপরাধীদের সম্পর্কে কিছু বললেন না। দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য তিনি যা বলা দরকার তা বললেন। কিন্তু তৃতীয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি সব বরবাদ করে দিলেন। অবস্থা এমন হলো যে ফক্স নিউজ ও মাদার জোনস ট্রাম্পের সমালোচনায় এক হয়ে গেল। এদিকে তার উপদেষ্টা প্যানেল থেকে ব্যবসায়ী নেতারা দল বেঁধে পদত্যাগ করতে শুরু করলেন। ট্রাম্প অবশ্য একজনের অকুণ্ঠ সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলেন। তিনি কু-ক্লাক্স-ক্লানের সাবেক অধীশ্বর ডেভিড ডিউক। চরম দক্ষিণপন্থীরা ট্রাম্পের পরোক্ষ আস্কারা পেয়ে আমেরিকাজুড়ে আরও বিক্ষোভের আয়োজন করবে। তাদের বিক্ষোভের রাশ টেনে ধরা ও শান্তি বজায় রাখার কাজটাকে এভাবে আরও জটিল করে তুলেছেন ট্রাম্প। আর এতে করে যে ক্ষতি হয়ে গেল তা ট্রাম্পের নিজের এজেন্ডার বাস্তবায়নকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনটি আমেরিকার অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। অথচ সেই উদ্যোগ তিনি অহেতুক ব্যাহত করলেন যেমনটি তিনি আগেও করেছেন। গত জুন মাসে ‘অবকাঠামো সপ্তাহ’ ধামাচাপা পড়ে যায় নির্বাচনে রাশিয়ার নাক গলানোর বিষয় তদন্ত নিয়ে। সেই তদন্তের এক পর্যায়ে ট্রাম্প এফবিআইয়ের ডিরেক্টরকে বরখাস্ত করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। একইভাবে ওবামা কেয়ার বাতিলের উদ্যোগটিও ভ-ুল হয় অংশত এই কারণে যে, বিদ্রোহী রিপাবলিকানদের সপক্ষে টেনে আনার মতো জ্ঞান ও ক্যারিশমা তার ছিল না। সেই উদ্যোগে মার খেয়ে তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ট্রাম্প সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতাকে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেন। অথচ আইন পাস করার জন্য তার সাহায্য ট্রাম্পের প্রয়োজন। ট্রাম্পের এই অদক্ষ রাজনৈতিক কলাকৌশলের উৎপত্তি নৈতিক ব্যর্থতা থেকে। শার্লোটসভিলে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী বিক্ষোভের পাশাপাশি পাল্টা বিক্ষোভও হয়েছে। এই পাল্টা বিক্ষোভে অংশ নেয়া কিছু লোকজনও বাস্তবিকই সহিংস হয়ে উঠেছিল। ট্রাম্প তার বক্তব্যে কোন এক জায়গায় এদের বিরুদ্ধে কঠিন শব্দাবলী ব্যবহার করতে পারতেন। তবে বিক্ষোভকারী ও পাল্টা বিক্ষোভকারীদের সমপর্যায়ে ফেলা তার মনের অগভীরতার পরিচায়ক। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে মিছিলকারীরা ফ্যাসিবাদী ব্যানার বহন করছিল, মশাল নাড়ছিল। লাঠি ও বর্ম উঁচিয়ে দেখাচ্ছিল আর নানা ধরনের বর্ণবিদ্বেষী সেøøাগান তুলছিল। অন্যদিকে পাল্টা বিক্ষোভের ফুটেজে দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিক্ষোকারীরা তাদের বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সেøøাগান দিচ্ছিল। আর সেটা তাদের করার অধিকারও আছে। কারণ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও নব্য নাৎসিরা এমন এক বর্ণবাদভিত্তিক সমাজ চায় যে সমাজের আবির্ভাব ঠেকাতে আমেরিকা একটি বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত লড়েছিল। কনফেডারেট মূর্তিগুলো রক্ষার জন্য যারা বিক্ষোভ মিছিল করছিল তাদের প্রতি ট্রাম্পের এক ধরনের আন্তরিক পক্ষপাতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এটা তার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিরই অংশ। এসব কিছুর মূলে রয়েছে ট্রাম্পের মনমানসিকতা। কঠিন সময়ে একজন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থাকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। ট্রাম্প শার্লোটসভিল ঘটনার ওপর তার দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে সে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টাও সে উদ্যোগ ধরে রাখতে পারেননি। কারণ যে মনমানসিকতায় তিনি বৃত্তবন্দী হয়ে আছেন সেই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাকে এই মানসিকতার উর্ধে উঠে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে। ট্রাম্প সর্বশেষ ঘটনাটির বাইরে আর কিছু দেখতে পারেন না। তার সেই দূরদৃষ্টি নেই। তিনি যে পদটি ধারণ করে আছেন সেটার মর্যাদা রক্ষা করাও তার একটা দায়িত্ব এটা অনুধাবন না করে তিনি শুধু নিজের মর্যাদার কথাই ভাবছেন এবং নিজের কক্সিক্ষত সাফল্যের জন্য আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। আমেরিকায় নানা ধরনের ও নানা চরিত্রের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। তবে তারা সবাই প্রেসিডেন্ট পদটিকে সম্মানিত করেছেন এবং নিজেরাও সম্মানিত হয়েছেন। রোনাল্ড রিগ্যানের নৈতিক মানদ- ছিল এবং রাজনৈতিক কৌশলগুলো অন্যদের হাতে অর্পণ করার মতো আত্মজ্ঞান ছিল। লিন্ডন জনসনকে অনেক দিক দিয়ে মেনে নেয়া কঠিন হলেও অনেক ভাল কিছু অর্জন করার মতো দক্ষতা তার ছিল। ট্রাম্পের না আছে আত্মজ্ঞান বা আত্মদর্শন, না আছে দক্ষতা। শার্লোটসভিলের ঘটনা সম্পর্কে তার ভূমিকাই প্রমাণ। যে নিজেকে বদলানোর মতো চরিত্র তার নেই। আমেরিকার এখন এক বিপজ্জনক মুহূর্ত। আমেরিকানরা দুই ভাগে বিভাজিত। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার হুমকি দেয়া, ভেনিজুয়েলায় হামলা চালানোর কথা বলা এবং শার্লোটসভিলের ঠিকানা নিয়ে বাকচাতুরি করার পরও ট্রাম্পের প্রতি রিপাবলিকান ভোটারদের চার- পঞ্চমাংশের সমর্থন এখনও রয়েছে। এখন জনপ্রিয়তা থাকায় দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা আরও বেশি কঠিন। এ থেকে প্রশ্ন ওঠে সরকারী ভদ্রপদে যেসব রিপাবলিকান রয়েছেন ট্রাম্পের প্রতি তাদের কেমন ভূমিকা নেয়া উচিত প্রশাসনে আসীন ব্যক্তিদের জন্য এ এক কঠিন প্রশ্ন। কেউ স্বপদে থেকে যেতে আবার কেউ কেউ পদত্যাগ করতে প্রণোদিত বোধ করেন। তবে তার উপদেষ্টাবৃন্দ বিশেষ করে পেন্টাগন ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের শীর্ষ পদে এবং তার চীফ অব স্টাফ হিসেবে আসীন তিন জেনারেলের পক্ষে ট্রাম্পের নিকৃষ্টতম প্রবণতাগুলো খর্ব করার সুযোগ কতখানি তেমন সুযোগ আর কারোর নেই। কংগ্রেস রিপাবলিকান সদস্যরা ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। কারণ তারা ভেবেছেন তিনি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করবেন। তাদের সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। ট্রাম্প রিপাবলিকান নন। তিনি তার স্বরোচিত নাটকের একক তারকা। তাঁর ভাগ্যের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে জড়িয়ে তারা শুধু নিজেদের নয় উপরন্তু নিজেদের দলও দেশের ক্ষতি করছেন। এই বোধোদয় তাদের যত তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×