ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিন

রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিয়ানমার ভূরাজনৈতিক কারণে ঝুলিয়ে রেখেছে। এতে মানবতা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী শাসকরা চরম ধর্মহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন। কেননা বৌদ্ধ ধর্মের মূলবাণী হচ্ছে অহিংসা। অথচ চরমভাবে বৌদ্ধ ধর্মের মূল অনুশাসন লঙ্ঘিত হচ্ছে। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে বাধ্য হচ্ছি- আইএস’রা বিশ্বে মুসলিম জঙ্গীর নামে যা যা করে আজ মিয়ানমারের শান্তি বিজয়ী আউং সান সুচি একই কাজ করছে। Geo Political region (ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল)-এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাই করছে। এ ঘটনা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল- আউং সান সুচির নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা নোবেল পুরস্কার কমিটির বিরাট ভুল। কারণ, শান্তিতে নোবেল পেয়ে বর্বরের মতো আচরণ করে আউং সান সুচি যে কলঙ্গের তিলক নিজ কপালে এঁটেছেন তা সরল দৃষ্টিতে দেখার নেই। সামরিক শাসন চরম ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের সঞ্চার করেছে মিয়ানমারে। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় মিয়ানমার হিংসার আগুনে জ্বলছে। সমুদ্র বিজয়ে বাংলাদেশের লাভ হওয়ায় মিয়ানমারের আউং সান সুচি এবং তার অনুসারী ও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানো সেনাবাহিনী মিয়ানমারে হিন্দু-মুসলমান কাউকেই স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। মিয়ানমারের মাথাপিছু আয় হচ্ছে ১৪২০.৫০ মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশের আয় হচ্ছে ১৬২০ মার্কিন ডলার। আসলে বঙ্গোপসাগর ঘিরে চীন যে আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল ধরেছে সেখানে মিয়ানমারের নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের অপপ্রয়াস ঘটাচ্ছেন। মিয়ানমারে আউং সান সুচিকে বলা চলে এ যুগের লেডি হিটলার। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মিথ্যাবাদী হওয়ার একটা সীমা থাকে। নির্বিকারচিত্তে মিয়ানমারের এ নেত্রী যখন বলছিলেন, কোন ধরনের অঘটন ঘটেনি; সব বাড়াবাড়ি। অথচ সীমান্তে বেপরোয়া মিয়ানমার বাহিনী যখন স্থলমাইন বিস্ফোরণ ঘটানোর ব্যবস্থা করে তখন এ ধরনের মিথ্যাবাদীর নাম ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে। অথচ বিমসটেক নামক আঞ্চলিক সংস্থায় ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার সদস্য। বিমসটেকের জরুরী বৈঠক ডাকা উচিত ছিল। কিন্তু সুচি থোড়াই কেয়ার করেন মানুষের মঙ্গল। পাল্টা তিনি মিয়ানমারের রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি করছে। আসলে দাবি পুরো মিয়ানমারের উন্নয়ন। কিন্তু এক চালাক-চতুর মহিলা ও মানবতা হত্যাকারী আউং সান সুচি জানেন, যদি বিশ্ব আদলে মানবতা হত্যাকারী হিসেবে বিচার হয় তবে কিছুই আশ্চর্যের হওয়ার থাকবে না। কি অদ্ভুত মিয়ানমারের সংবিধান-তাদের দেশের সংবিধানে সংখ্যালঘু হিন্দু-মুসলমানদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। সুচি নিজে ক্ষমতায় থাকার লোভে বিষয়টি হালকা চালে দেখেছেন- ওরা যেন মানুষ নয়, পিঁপড়ে। অথচ বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী পিপড়ে মারা মহাপাপ। নাফ নদীতে যখন লাশ পাওয়া যাচ্ছে তখন মহানন্দে সুচি রাখাইন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলছে। জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিন লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে; যদিও সরেজমিনে এটি পাঁচ লাখেরও কম হবে না। মানব সমস্যা সমাধান না করে আউং সান সুচি মানুষকে ভুল বোঝাতে ব্যস্ত। নরেন্দ্র মোদি ইতোমধ্যে মিয়ানমারে গেছেন। তিনি সোজাসাপটা বার্তা দিয়েছেন, রাখাইন অস্থির পরিবেশে ভারত উদ্বিগ্ন। কোফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিয়েছেন। অথচ এবার যখন মানব হত্যার বর্বরোচিত ঘটনা ঘটছে তখন সুচি আগে বলেছিলেন যে, জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আনানের রিপোর্টই দায়ী। এটি একটি নিদারুণ মিথ্যা কথা। এই মিথ্যা ওপর সকল মানবতা পদপিষ্ট হচ্ছে। জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাস মিয়ানমারের চলমান সংহিসতায় উদ্বিগ্ন। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বর্তমান পৃথিবীর বর্বর, হত্যাকারী, নরপিশাচ দল হিসেবে বিবেচিত হবে। ভয় হয় আউং সান সুচির নিকৃষ্টতম নেত্রীত্বের জন্য এই অঞ্চলে জঙ্গীবাদ না আবার মাথা চাড়া দেয়। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের আওতায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহায়তা পেয়ে সন্ত্রাস, হত্যাকা-, নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিক্রি বাড়ায়। তবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়াবাড়ির জন্য আউং সান সুচির মুসলিম বিদ্বেষ এবং বছরের পর বছর নিরাপত্তা বাহিনীকে এ ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তিনি আরেকটি বিষয় প্রমাণ করেছেনÑ মানুষের রক্তের হোলিতে তার চাই ক্ষমতা। তিনি অনেকটা আমাদের দেশের খালেদা ও তারেকের সমতুল্য। অথচ মানুষ হিসেবে কি ধরনের জালিয়াত হচ্ছে সুচি- এখন পর্যন্ত সহিংসতা এড়িয়ে একটি সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রকাশ করতে বা উদ্যোগ নিতে পারছেন না। বরং তিনি মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। অসাম্প্রদায়িক নীতিতে রাষ্ট্র, দল আর তার অধীনস্থ নিরাপত্তা বাহিনীকে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেখ হাসিনা এখন বৈশ্বিক নেত্রী। তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। তার এ মহৎ কাজের জন্য এ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সঙ্গে কেবল তুলনা করা যায়। সেসঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে এক কোটি মানুষ আশ্রয় দিয়েছিল তা স্মরণ করছি। আমরা জানি, আমাদের সেনাবাহিনী অনেক দক্ষ। কিন্তু বাঙালী আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। মানব সেবার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা এক অসামান্য নারী। এদিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের আঞ্চলিক সংস্থাগুলো আগামী তিনমাসের জন্য বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য এক কোটি আশি লাখ ডলার সাহায্য চেয়েছেন। তবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সামাজিক বিপর্যয় নষ্ট করতে পারে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা। তাদের অবশ্যই দেশে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। আমরা বিদেশী সাহায্য চাই না। চাই মানবতার সঙ্গে মাথা উঁচু করে রোহিঙ্গারা নিজের দেশে ফিরে গিয়ে বাঁচুক। ইন্দোনেশিয়া-তুরস্কসহ বিশ্বের সকল বিবেক এই সংকট সমাধানে প্রয়োজনে বিষদ আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারকে বাধ্য করাক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। যেভাবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে তাতে তাদের বর্বর হিসেবে অভিহিত করা যায়। তবে এদেশে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে জঙ্গী, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ীর অনুপ্রবেশ না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নচেৎ বাংলাদেশের পাশাপাশি সমস্যা ভারতের দিকেও প্রসারিত হবে। পাকিস্তান কিন্তু মিয়ানমারের কর্মকা-ে অনেকখানি নীরব। স্বাভাবিকভাবেই তারা কখনও বাংলাদেশের উন্নতি চায় না। সুচিকে অবশ্যই চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণ্য বলয় থেকে বেরিয়ে এসে শান্তির দিকে এগুতে হবে। চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ সবার উচিত মিয়ানমারকে বয়কট করা। পাশাপাশি এ ধরনের হিংস্র কাজের জন্য পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। আজ বিশ্ববিবেককে একটি বিষয়ে সোচ্চার হতে হবেÑ রোহিঙ্গারা তাদের মূল দেশ মিয়ানমারে যাতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন। ইতিহাস বলে, মিয়ানমারের মুসলমানরা আরব বণিকদের বংশধর। একটি গ্রুপ যদি কোন দেশে সহস্র বছরের অধিককাল থাকে তারপরও তাদের কেন এদেশে পাঠানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এই চক্রান্তে চীনকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চয়ই ওবামার মতো আউং সান সুচিকে প্রশ্রয় দেবেন না। বরং ট্রাম্পের কাছে প্রত্যাশা- এ ধরনের ঘৃণ্য কাজের জন্য অবশ্যই মিয়ানমারকে চাপ দেবেন এবং বাধ্য করবেন ন্যায়সঙ্গত আচরণের জন্য। ওআইসির একটি বিশেষ সম্মেলন এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি নিয়ে এখনই কথা বলার উপযুক্ত সময়। মানবতাহীন দুষ্কৃতকারী হিসেবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। এদেশের নেত্রী যে ধরনের উদারতা দেখিয়েছেন তা থেকে সুচির শিক্ষা নেয়া উচিত। অবশ্য যে জেগে ঘুমায় তার ঘুম ভাঙ্গানো যায় না। বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বর্তমান সরকারের আমলে ঘটছে তা মিয়ানমারের চক্ষুশূল। মানুষ কর্মের মাধ্যমে বাঁচে। মানবতার চেয়ে বড় কিছু নেই। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার এ সুযোগে যাতে অঞ্চলগত ভারসাম্য বিনষ্ট না হয় তাই মিয়ানমারের প্রতি এই ইস্যুতে আরও কঠোর হতে হবে ভারতকে। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তা বন্ধ করতে হবে। যদি সুনির্দিষ্ট কোন সংগঠন বা গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে যৌথভাবে তা দমন করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে যারা ধর্মব্যবসায়ী এবং কিছু ইসলামিক জঙ্গী পৃষ্ঠপোষক কোন এনজিও থেকে থাকে তাদের অবশ্যই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে কাজ করতে দেয়া যাবে না। রোহিঙ্গারা সম্মানের সঙ্গে তাদের দেশে ফিরে যাক একজন বিশ্ব মানব হিসেবে এটাই দাবি। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই দূতিয়ালি করতে হবে। আমাদের সমুদ্র সম্পদের দিকে মিয়ানমারের যে লক্ষ্য সেই অভিলাষ যাতে পূরণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশ মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান সবার দেশ। শেখ হাসিনা এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দ্বিধাহীনভাবে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সদাজাগরূক। আন্তর্জাতিক পরিম-লে আরও কূটনৈতিক প্রেরণ করে বাংলাদেশ বিশ্ববিবেকের কাছে সমস্যার সমাধান ত্বরান্বিত করতে চাপ দিতে পারে। যারা আজ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত তাদের প্রমাণসাপেক্ষে আইনের আওতায় আনা হোক। কিন্তু নিরীহ মানুষকে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং তাদের বাড়িতে পুনর্বাসনের দায়িত্ব আউং সান সুচিকে নিতে হবে। আতাউল্লাহকে ধরতে না পেরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। এআরএসকে দমনে বাংলাদেশ ভারত-মিয়ানমারকে সাহায্য করতে পারে। মানবিক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য আউং সান সুচির আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ [email protected]
×