ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

অভিমত ॥ গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আর কতদূর?

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

অভিমত ॥ গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আর কতদূর?

‘লালন তোমার আরশিনগর আর কতদূর, আর কতদূর...’ শীর্ষক লালনগীতির ন্যায় আমাদের দেশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় চলতি বছর উত্তীর্ণ হওয়া কয়েক লাখ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবকদের মনেও যেন এখন উদিত হচ্ছে, ‘গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আর কতদূর... আর কতদূর।’ গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতির পরীক্ষায় মূলত একই প্রশ্নপত্রে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে সবচেয়ে লাভবান হবেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন- সিলেটে অবস্থিত কোন একটি বিশ^বিদ্যালয়ে সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন, যার অর্থ সারাদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে সিলেটে আসতে হয়। কিন্তু সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। কারণ, তখন সেই উত্তরবঙ্গের বা দক্ষিণবঙ্গের ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের আর কষ্ট করে সিলেটে যেতে হবে না। তাঁরা তাঁদের কাছাকাছি রাজশাহী বা যশোর ক্যাম্পাসেই পরীক্ষা দিতে পারবে। ঠিক একইভাবে সিলেট এলাকার কোন ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রী যদি যশোরে অবস্থিত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান তাঁকে তখন আর কষ্ট করে যশোর যেতে হবে না, তিনি সিলেটে বসেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন বিভাগের জন্য বিবেচিত হতে পারবেন। যা হোক, সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ২০০৮ সাল থেকে আলোচনার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উপাচার্যদের সভায় বেশির ভাগ উপাচার্য সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছিলেন। এরপর এ নিয়ে আরও কয়েক দফা আলোচনাও হয়। কিন্তু ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। বছর দুয়েক আগে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও ‘অজ্ঞাত কারণে’ শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল কলেজের মতো ক্লাস্টার বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা গত নয় বছর ধরে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত ফলাফল শূন্যের কোঠাতেই বিরাজ করছে। অর্থাৎ গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবারও চালু হচ্ছে না। আগামীতেও তা চালু হবে কিনা কিংবা আদৌ চালু হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। ফলে বিগত বছরগুলোর ন্যায় এবারও দুর্ভোগ পোহাতে হবে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন। চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ভাল ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তিযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাফল্যের সিংহ দরজা অতিক্রম করে উচ্চশিক্ষার নতুন ভুবনে প্রবেশের ছাড়পত্র পাওয়া লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে এখন ভর্তি পরীক্ষা নামক বিরাট যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে আরামের ঘুম হারাম করে, খেলাধুলা বন্ধ করে, প্রচ- মানসিক চাপ নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে বেড়াতে হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাশাপাশি ‘ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ’ হিসেবে থাকবে ভর্তিচ্ছুদের অভিভাবকদের ভোগান্তি ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়। আমাদের দেশে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক পৃথক দিনে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকলেও আজ একটিতে পরীক্ষা দিল তো আগামীকাল আবার আরেকটিতে পরীক্ষা দিতে যথাসময়ে পৌঁছানোর জন্য বেশ তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকতে হয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রান্ত বা সীমানা পাড়ি দিতে হয় কখনও নদীপথে, কখনও সড়কপথে আবার কখনও রেলপথে। এ জন্য প্রায় একটা লম্বা সময় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পথে পথেই কাটাতে হয়। এতে করে না হয় ঠিকমতো ঘুম, না থাকে গোসল, না থাকে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া। দীর্ঘ পথ ভ্রমণে অনেকেরই থাকে অনভ্যস্ততা। আর এ কারণে তাঁরা অনেক সময় স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়ে থাকেন। আগে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম থাকায় পৃথক পৃথক পরীক্ষা হলেও খুব একটা বেশি সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি করে। ইতোমধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়। এখানে আগের মতোই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক পৃথক ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এবারও লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সরকারী ও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো যদি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে ফলাফলের ভিত্তিতে কে কোন্ মেডিক্যালে পড়বেন তা ঠিক করে দিতে পারে, তাহলে কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস্টার বা গুচ্ছ কিংবা সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করে না বা করতে পারে না? এক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়? বলাবাহুল্য, ইউজিসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও কোচিংনির্ভর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া ইউজিসির উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) এক গবেষণায় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়- এ তিনটিকে গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। মেডিক্যাল কলেজগুলোর উদ্যোগে পরিচালিত কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা পদ্ধতি স্বচ্ছ হওয়ায় ইতোমধ্যে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পদ্ধতি চালু করার পক্ষে গত নয় বছর ধরে প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে আসলেও এক্ষেত্রে যেন কোনই লাভ হচ্ছে না। কারও কারও অভিমতÑ দেশের ৪০টি সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে নেয়া সমস্যা। যদি তা-ই হয় তাহলে সেক্ষেত্রে গুচ্ছ পদ্ধতি শ্রেয়। এক্ষেত্রে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একেকটি গুচ্ছের মধ্যে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। সরকার যদি একযোগে মাসব্যাপী আট-নয় লাখ শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন তাদের ভর্তি পরীক্ষা একযোগে সফলভাবে নিতে পারবে না? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, জেএসসি প্রবর্তন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাসের হার বাড়ানোসহ বেশকিছু ইতিবাচক অর্জন রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও প্রশংসা এবং সাধুবাদ পাবে যদি দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকরা যদি ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে পাওয়া আয়ের বিষয়টি মাথা বাদ দিতে পারেন এবং ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের সীমাহীন দুর্ভোগ এবং কষ্টের বিষয়গুলো সুবিবেচনা করে এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলেই কেবল গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি সম্ভব। অন্যথায় তা সম্ভব নয়। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভর্তি প্রার্থী নির্বাচন করা হলে ছাত্রছাত্রীরা মানসিক চাপ ও অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা পাবেন এবং তাঁদের অভিভাবকদেরও মানসিক ও আর্থিক চাপ কমবে। পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতি হবে উপকৃত। তবে এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক সহযোগিতা এবং আন্তরিকতা। লেখক : ফিলিপিন্সের লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিন্স ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর। [email protected]
×