ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

১০তলাবিশিষ্ট ‘লাক্সারী প্যালেস’

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১০তলাবিশিষ্ট ‘লাক্সারী প্যালেস’

নিজস্ব সংবাদদাতা, ফরিদপুর ॥ ১০ তলার ভবন। দাঁড়িয়ে আছে শহরের অভিজাত এলাকায়। প্রতি তলায় চারটি করে ফ্ল্যাট। একটি অফিস কক্ষের জন্য রেখে বাকি ৩৯টি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন ৩৯ পরিবার। ২৭ ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। বাকি ১২টি মালিকের ভাড়াটিয়ারা থাকেন। সব মিলিয়ে ভবনে নিবাসীর সংখ্যা দুই শতাধিক। নামে ‘লাক্সারী প্যালেস’ এবং ফরিদপুরের অভিজাক ঝিলটুলী মহল্লায় স্থাপিত হলেও এই ভবনটির বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে নির্মাণের সময় ভবনে কোন সেপটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল নির্মাণ করা হয়নি। এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন ওই ভবনের মালিক মোঃ গোলজার আহম্মেদ খান। ‘পৌরসভা আমাকে যে নক্সা পাস করে দিয়েছিল তাতে সেপটিক ট্যাংক বা ছোকয়েল ছিল না’-মন্তব্য করে গোলজার আহম্মেদ বলেন, ‘তবে পরে আমি সেপটিক ট্যাংক বা সোকয়েল করে দিয়েছি।’ ওই ভবনের নিবাসীরা জানায়, ভবনে ফ্ল্যাট কিনে কিংবা ভাড়া থাকার সুবাদে তারা পর্যায়ক্রমে জানতে পারেন ওই ভবনে সেপটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল নেই। বাথরুম, পায়খানা এবং রান্নার পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে পৌরসভার ড্রেনের মাধ্যমে। তখন আমরা মালিকের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ করি এবং অবিলম্বে সেপটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল নির্মাণের দাবি জানাই। একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করার পর সেপটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেল সেই অভিনব পদ্ধতি। শহরের ১১৮ নম্বর ফরিদপুর মৌজার আরএস ১০৩ ও এসএ ৯৪ নং খতিয়ানের ১৭৫১ নং দাগে ফরিদ শাহ্ সড়কে সাড়ে আট শতাংশ জমির উপর নির্মাণ হয়েছে লাক্সারী প্যালেস। ২০০৭ সালে এ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালের নবেম্বর থেকে নিবাসীরা বসবাস শুরু করে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বহুতল ওই ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর যেটি গাড়ি রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেখানে পূর্ব দিকে দুটি পিলারের মধ্যে দেয়াল তুলে ছোট একটি ত্রিভুজ আকৃতির সেফটিক ট্যাংক করা হয়েছে। যদিও বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে সেফটিক ট্যাংকের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ভবনের ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) স্থাপনের পর পরই। ছোকয়াল করা হয়েছে ভবনের সামনে ফরিদ শাহ সড়কের পাশে পৌরসভার জায়গা ইজারা নিয়ে। সরজমিনে দেখা গেছে, নব নির্মিত ওই সেফটিক ট্যাংক থেকে ছোকয়েলটি অনুমানিক তিন ফুট উপরে নির্মিত। যা কাজে আসার সুযোগ নেই। ‘এই সেফটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল একটি আই ওয়াশ’-মন্তব্য করে ওই ভবনের নিবাসী এমএ তাহের বলেন, প্রকৃত পক্ষে ওই ভবনের পয়বর্জ্য অপসারণের সংযোগ পৌরসভার নর্দমার সঙ্গে সংযুক্ত। যে সেফটিক ট্যাংক করা হয়েছে তাতে ওই ভবনের দক্ষিণ অংশের নিবাসীদের স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ দেয়া গেলেও উত্তর দিকের নিবাসীদের স্যুয়ারেজ সংযোগ নর্দমার সঙ্গেই রয়েছে। এর ফলে ওই নর্দমা দিয়ে প্রতিনিয়ত পয়বর্জ্য কুমার নদে গিয়ে পড়ছে, এতে দূষিত হচ্ছে নদের পানি। ভবনের নিবাসীরা অভিযোগ করেছেন, ভবনের পয়ঃসংযোগের নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে মলমূত্র বাহিত ওই পাইপ ছিদ্র হয়ে মলমূত্র ভবনের নিচে পরায় দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। গত ১ জুলাই ওই ভবনের ১৬ নিবাসী লাক্সারী প্যালেসে সেপটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল নির্মাণ না করায় বিষয়টি অবগত করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান ফরিদপুর পৌরসভার কছে। অনুলিপি দেয়া হয় গণপূর্ত বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে। ওই আবেদনে বলে হয়, আমরা দেখছি ওই ভবনে দূষিত পানি, মল ইত্যাদি নিষ্কাসনের জন্য মালিক কোন সেফটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল নির্মাণ করেনি। এ অবস্থায় দূষিত পানি মল ও আবর্জনা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় কারণে দুর্গন্ধে উক্ত ফ্ল্যাটে বসবাস করা আমাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে এবং উক্ত মল ও আবর্জনা পৌরসভার ড্রেনে সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট মালিকগণ অভিযোগ করেন, ভবন মালিক ফ্ল্যাট ক্রয়ের শুরু থেকেই তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। ভবনের প্লানের সত্যায়িত কপি অদ্যাবধি আমাদের দেয়নি। ফ্ল্যাট মালিকগণ আরও অভিযোগ করেন, এসব এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য না করার জন্য ভবনের মালিকের পক্ষ থেকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। প্রতিবাদকারীদের নানা ভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। ওই ভবনের মালিক গোলজার আহম্মেদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি গত ১০ জুলাই ভবনের প্রতিবাদী নিবাসী এসএ তাহেরের নামে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায়, ‘চাঁদা দাবি’সহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে কোতোয়ালি থানার পুলিশ এসএ তাহেরকে থানায় নিয়ে আটকে রাখে। নয় ঘণ্টা আটকে রাখার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে গোলজার আহম্মেদের সঙ্গে ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে, নিয়ম মেনে চলব, কোন সমস্যা হলে মালিককে জানাব, ফ্ল্যাট বিক্রিতে কোন হস্তক্ষেপ করব না’- মর্মে লিখিত অঙ্গিকার নামা আদায় করার পর তাহেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে ওই অঙ্গিকারনামার কোথাও চাঁদাবাজির অভিযোগটি যুক্ত করা হয়নি। অভিযোগ প্রসঙ্গে লাক্সারী প্যালেসের মালিক গোলজার আহম্মেদ খান বলেন, ফ্ল্যাটের ক্রেতারা সব শর্ত মেনেই ফ্ল্যাট কেনেছেন। তিনি বলেন, বাড়ির নক্সায় সেফটিক ট্যাংক ও ছোকয়েল ছিল না বলে করা হয়নি। পরে করে দেয়া হয়েছে। পয়বর্জ্য পৌরসভার নর্দমারয় ফেলা হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, তাহের নিজে ফ্ল্যাট কেনেননি। কিনেছে তার স্ত্রী। অথচ তিনি (তাহের) এ ভবনের মালিক সমিতির নেতা হতে চাচ্ছেন, এজন্য নানা ধরনের ঝামেলা করছেন। এজন্যই পুলিশের হস্তক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফরিদপুরের পৌর মেয়র শেখ মাহতাব আলী ওরফে মেথু বলেন, লাক্সারী প্যালেসের সকল ফ্ল্যাট বাড়ির মলমূত্র পৌরসভার ড্রেনের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থার নেয়ার জন্য মালিককে একাধিকবার নোটিস দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি (গোলজার) কোন নোটিসের কোন জবাব দেননি। মেয়র বলেন, এ বিষয়ে আমরা অতিসত্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
×