ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র মাদারীপুরের লেক

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র মাদারীপুরের লেক

লেক কৃত্রিম হোক বা প্রাকৃতিক হোক যে কোন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। আর তা যদি হয় আধুনিক সৌন্দর্যবর্ধন করা তা হলে তো আকর্ষণটা বেশিই থাকে। এমনই এক দৃষ্টিনন্দন সরবর মাদারীপুর লেক। শহরের প্রাণ কেন্দ্রের বিশাল এলাকাজুড়ে যে কৃত্রিম লেক রয়েছে যা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক সময় নগরায়ণের প্রয়োজনে এই লেকটি খনন করা হয়। বর্তমানে এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মানুষের মন কেড়ে নেয়। বর্তমানে লেকের সৌন্দর্য আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করে পৌর কর্তৃপক্ষ। গত বছর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সাড়ে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে আরও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়। এখন সৌন্দর্যপিপাসু বহু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন সকাল-বিকেল ছুটে আসে লেকের পাড়ে। সকালের নির্মল হাওয়া আর বিকেলের পায়চারি সে তো শহরবাসীর নিত্যদিনের ঘটনা। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই লেকে হাজারো সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ খুঁজে পায় মনের প্রশান্তি। সব ঋতুতেই রাত অবধি চলে লেকের পাড়ে সর্বস্তরের মানুষের আসা-যাওয়া। লেকের এই বিনোদন কেন্দ্রকে ঘিরে এক শ্রেণীর গরিব মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভাসমান ফেরিওয়ালারাও পেয়েছে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। ইতোমধ্যে মাদারীপুর লেকের সুনাম-সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য জেলার বাইরে থেকেও লোকজন আসতে শুরু“করেছে। মূলত কৃত্রিমভাবে লেকটি খনন করা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে ফুটে উঠে এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যকে আরও সৌন্দর্যবর্ধন করে গড়ে তুলতে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি, পৌর মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদের রয়েছে বিশেষ অবদান। মূলত তাদেরই চিন্তা-চেতনার ফসল আজকের এই সৌন্দর্যবর্ধিত মনোমুগ্ধকর লেক। লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা সব বয়সী মানুষের জন্য রয়েছে মুখরোচক নানা ধরনের খাবারের দোকান। অতি ভোজন রসিকদের জন্য রয়েছে মিনি চাইনিচ রেস্তরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকান। আছে পিঠাপুলি ও নামী-দামী চটপটি-ফুস্কার সমাহার। শিশুদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় খেলনার দোকান। ১৯৪২-৪৩ সালে মাদারীপুর শহরের মাঝামাঝি শকুনি এলাকায় ২০ একর জমি নিয়ে এই লেকটি খনন করে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসন। ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে প্রমত্তা পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় যখন মাদারীপুর মূল শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে থাকে। তখন নতুন করে শহর স্থানান্তরের জন্য মাটির প্রয়োজনে ১৯৪২-৪৩ সালে এ লেক খনন করা হয়। সে সময় এ এলাকাটি ছিল জনমানবহীন এবং বনজঙ্গলে ভরা একটি নিম্নভূমি। নদীভাঙন কবলিত তৎকালীন মহকুমা শহরের কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, থানা, জেলখানাসহ সরকারী কর্মকর্তাদের বাংলো স্থানান্তরের জন্য এই এলাকাটি বেছে নেয়া হয়। কারণ সমতলে এ সব স্থাপনা তৈরি জন্য প্রচুর মাটির প্রয়োজন হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মাদারীপুর মহকুমা প্রশাসন এই লেকটি খনন করে মাটির চাহিদা পূরণ করে। চল্লিশের দশকে প্রচুর মাটির প্রয়োজনে বিশাল এই লেকটি খনন করতে বহুসংখ্যক মাটিকাটা শ্রমিক দরকার হয়। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এ অঞ্চলে না থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সময় ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল থেকে দই হাজার মাটি কাটা শ্রমিক আনা হয়। লেক খননের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় উড়িয়ার নাঞ্জিপুঞ্জি নামের এক আদিবাসীকে। নাঞ্জিপুঞ্জির তত্ত্বাবধানে ভারতের ওই দুই রাজ্য থেকে আসা দুই হাজার শ্রমিক ২০ একর জায়গার মাটি কেটে লেক খনন শুরু করে। প্রায় ৯ মাসে লেকের খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়। লেকের খনন কাজ সম্পন্ন হওয়ার শেষ মুহূর্তে কলেরায় ৭ শ্রমিক মারা গেলে অন্যান্য শ্রমিক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং কোন এক রাতের অন্ধকারে তারা পালিয়ে যায়। সেদিনের সেই কৃত্রিম লেক আজ এক দৃষ্টিনন্দন সরবর-মানুষের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। বহিরাগত যে কেই মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করেই এই লেকের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেই। লেকের পশ্চিম পাড়ে রয়েছে লেক ভিউ ক্লাব, উদয়ের পথে শিশু বিদ্যালয়, ঐতিহাসিক জামে মসজিদ ময়দান। দক্ষিণে সার্কিট হাউস, মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন, জাতীয় মহিলা কল্যাণ সংস্থা ভবন, জনস্বাস্থ্য অধিদফতর ভবন, চৌধুরী ক্লিনিক। লেকের পূর্ব পাড়ে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো, সদর হাসপাতাল, সিভিল সার্জন ভবন, জেলা কারাগার, পুলিশ লাইনস ময়দান। উত্তরে বঙ্গবন্ধু ‘ল’ কলেজ, সরকারী পাবলিক লাইব্রেরি, পুরাতন কোর্ট, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, স্বাধীনতা অঙ্গন এবং জেলার সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাংলো। দৃষ্টিনন্দন এই লেকের কাজল কালো স্বচ্ছ জল আর শীতল হাওয়ায় ক্লান্ত পথিকেরা পাড়ে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে গা জুড়িয়ে নেয়। পড়ন্ত বিকেলে দূর থেকে লেকের চেহারায় ফুটে ওঠে প্রকৃতির ছবি। এ যেন কোন শিল্পীর হাতে আঁকা প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যপট। এই লেকটি শত শত বছরের পুরনো মাদারীপুর শহরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপ-শহর রাজউকের নির্মাণাধীন পূর্বাচল উপ-শহর হয়ে ওঠেছে উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। প্রকল্পটির খোলামেলা পরিবেশে ঢাকা শহর ও আশপাশের জেলার বাসিন্দারা যে কোন উৎসবকে ঘিরেই ঘুরতে আসছেন এখানে। বিশেষ করে এখানকার বাঙ্গালবাড়ি বাতিঘরে সাধারণ লোকজন ভিড় করছে প্রাচীন ব্যবহার্য তৈজসপত্র ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার নানা সংরক্ষণ দেখতে। এছাড়াও প্রকল্পটির পশ্চিমপারে বালু নদী ও পূর্বপারে শীতলক্ষ্যার তীরে এসে কাশফুলের নরম ছোঁয়া নিচ্ছেন দর্শনার্থীরা। সরেজমিন ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রাজউকের অধীনে নির্মাণাধীন পূর্বাচলের চিত্র। পবিত্র ঈদ-উল-আযহার দিন থেকে শুরু করে এখনও দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন উন্মুক্ত বিনোদনের স্বাদ নিতে। এখানে বেড়াতে এসে সব রকম বিনোদন পাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, চরকি চড়া, নৌকা দোলা, নৌকা ভাড়া করে নদীতে ঘোরা, ইচ্ছে হলেই সাঁতার কাটা এছাড়াও বেশ কয়েকটি সুইমিং পুলে সামান্য অর্থ খরচ করে সাঁতার কাটানোর নিরাপদ পরিবেশ পাওয়ায় জমে ওঠেছে এখানকার ঈদ বিনোদন। তাই স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দর্শনার্থীরা। তাদের আহারের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত অস্থায়ী খাবার হোটেল। যেখানে সাধারণ খাবার থেকে শুরু করে বিদেশী রান্না করা খাবার মিলছে স্বল্প দামে। এতে আকৃষ্ট হচ্ছেন তারা। এ ছাড়াও পূর্বাচল উপ-শহরের আশপাশের পার্কগুলোও ঘুরে দেখছেন। যদিও সেখানে টাকা খরচ করে প্রবেশ করতে হয়। তবে বেশ মজা নিচ্ছেন পূর্বাচলের নির্মল পরিবেশে ঘুরে। বিশেষ করে পূর্বাচল উপ-শহরের ৯নং সেক্টরে বাঙ্গাল বাড়িতে ভিড় করছেন উৎসুক জনতা। বাঙ্গালবাড়ি বাতিঘর নামক একটি জাদুঘর দেখতে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। সম্প্রতি বাঙ্গাল বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এ বাড়িটিতে রয়েছে পুরনো নানা স্মৃতি বিজরিত সব সংরক্ষণ। বাপ-দাদা ও দাদার দাদার কালের নানা ব্যবহৃত তৈজসপত্র দেখতে দর্শনার্থীরা তাদের পরিবারের সদস্য ও শিশুদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। কথা হয় আবদুল হক ভুঁইয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহিরা তাসফি প্রভার সঙ্গে সে জানায়, প্রথমবার হুক্কা, হারমোনিয়াম, গিটার, একতারা, যাঁতা, সিঁকা, কাহাল ছিঁয়া, বিশেষ দোলনা, পাখা, চাপ টিউবওয়েল, গরুর গাড়ি, পালকি, বাবুই পাখির বাসা, মাটির হানকি, বাঁশের বাঁশি, বিন ইত্যাদি সরাসরি দেখেছে। এর আগে এগুলো বইয়ে পড়েছে বলে জানায়। এ সময় প্রভা আরও জানায়, বাঙ্গাল বাড়িতে আরও অনেক কিছু আছে যা সে চিনে না। তার পিতাও বলতে পারেননি। পরে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে আশ্বস্ত করে। স্থানীয় সাংবাদিক মাহবুব আলম প্রিয় বলেন, পূর্বাচল উপ-শহরে যে কোন ধর্মের লোকজন সাধারণ ছুটিতেও ভিড় করেন। রাজধানীর অতি সন্নিকটে হওয়ায় রাজধানীর চার দেয়ালে থাকা মানুষগুলো একটু খোলামেলা পরিবেশ পেয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। এখানকার বাঙ্গালবাড়িটি ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। দর্শনার্থীরা নানা পুরনো সংরক্ষণ দেখতে গিয়ে একটু সময়ের জন্য হলেও ফিরে যাচ্ছেন দাদার আমলে। মনে করছেন সেই সময়ের ঢেঁকি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ধান মাড়াইয়ে ব্যবহৃত নানা কাস্তে, খুন্তি, পালকি ইত্যাদি নানা সুখস্মৃতিগুলো। এছাড়াও পূর্বাচলের আশপাশের পার্কগুলো বিশেষ করে জিন্দা পার্ক, পন্ড গার্ডেন, রাসেল পার্ক, ফনল্যান্ড পার্ক , পেরাবর তাজমহল ঘুরেও বেড়াচ্ছেন দর্শনার্থীরা। এখনও ঈদের আমেজ কাটেনি। তারপর আবার দুর্গাপূজা আসছে। তাই দর্শনার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। মীর আবদুল আলীম, রূপগঞ্জ থেকে আবদুল জলিল শিশুপার্ক এই জেলা ধানের জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে মানুষের বিনোদনের কোন জায়গা নেই। শিশু কিশোর আর মানুষের বিনোদনের কথা ভেবে শহরের বাইপাস সড়কের পাশে ‘আবদুল জলিল শিশু পার্ক’ নির্মাণ করা হয়। এই পার্কে এখন উপচেপড়া ভিড়। শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সমন্বয়ে এখানে সৃষ্টি হয় এক মিলন মেলার। তবে একাধিক দর্শনার্থীর অভিযোগ প্রবেশ মূল্য নিয়ে। প্রবেশ মূল্য ৩৫ টাকা ধার্য করা হয়েছে যা বিভাগীয় শহরকে হার মানিয়েছে। এ মফস্বল শহরে এত উচ্চহারে প্রবেশ মূল্য দিয়ে দর্শনার্থীরা শিশু পার্কে প্রবেশ করবে না বলেও অভিমত ব্যক্ত করে। এ পার্কের আয়তনে কম হলেও ঢাকা শিশু পার্কের মানে এটির অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। শিশুরা এখানে এসে অনেক আনন্দ ও বিনোদন উপভোগ করছে। এ বিষয়ে জননেতা আবদুল জলিল পার্কের ইজারাদার ঢাকার ধানম-ির মেসার্স ডমেস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজির পক্ষে রফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, এ শিশু পার্কটি সবেমাত্র ঈদের দিনে প্রাথমিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। এখনও পার্কের কাজ সম্পন্ন হয়নি। তিনি পার্কটির প্রবেশ মূল্যের দর্শনার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, এ শিশু পার্ক ১ বছরের জন্য প্রায় ১৮ লাখ টাকায় ইজারা নেয়া হয়েছে। জেলা পরিষদের নির্ধারিত প্রবেশ মূল্যসহ বিভিন্ন রাইডের টিকেট মূল্যের চেয়ে বেশি নেয়া হয়নি। তবে টিকিটের হার কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ, থেকে
×