ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফ সড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল রোহিঙ্গা ঝুপড়ি

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

টেকনাফ সড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল রোহিঙ্গা ঝুপড়ি

হাসান নাসির, কক্সবাজার থেকে ॥ পর্যটন শহর কক্সবাজার হতে টেকনাফ যাওয়ার পথে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় থেমে যায় সকল যানবাহনের চাকা। এরপর বাকি পথটুকুর অপর নাম সীমাহীন দুর্ভোগ। না, দুর্ঘটনা কিংবা সড়ক বিনষ্টজনিত সমস্যা নয়, দু’পাশে মাইলের পর মাইল লাখ লাখ শরণার্থী। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি সহিংসতার পর প্রাণ বাঁচাতে এরা ছুটে এসেছে নাফ নদীর এপারে। কুতুপালং এবং বালুখালীতে রীতিমতো গিজগিজ অবস্থা। টেকনাফ সীমান্ত শহরের চিত্রও তেমনই। রোহিঙ্গারাই এখন সেখানে সংখ্যাগুর। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সহানুভূতি এবং আবেগের পাশাপাশি কাজ করছে এক ধরনের আতঙ্কও। প্রশ্ন একটাই, মিয়ানমার সরকার এদের ফিরিয়ে নেবে তো? আর না নিলে আমাদের কী হবে? দোকানগুলোতে দেখা দিয়েছে পণ্য সঙ্কট। ফলে প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যই বাড়তি। তাছাড়া একসঙ্গে এত বেশি মানুষকে ধারণ করায় পরিবেশের ওপরও পড়তে শুরু করেছে বিরূপ প্রভাব। পরিস্থিতির শিকার এই রোহিঙ্গারা জানে না, কী তাদের ভবিষ্যত। কী আছে তাদের ভাগ্যে? ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিশুগুলো। বৃদ্ধ ও নারীদের চেহারায় নিদারুণ অসহায়ত্বের চাপ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীসহ (ডব্লিউএফপি) বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে আসছে খাদ্য সহায়তা। কিন্তু এত বেশি মানুষের তুলনায় তা স্বাভাবিকভাবেই অপ্রতুল। রাখাইন প্রদেশের মংডু থেকে আসা ইব্রাহিমের বয়স আনুমানিক ৫০। জানালেন, তারা ফিরতে চান না নিজভূমে। কারণ সেখানে জানমালের নিরাপত্তা নেই। সম্পদ যৎসামান্য যা ছিল, তা তো গেছে। এখন জান নিয়ে বাঁচতে চান। কিন্তু এটা তো আপনাদের দেশ নয়, থাকবেন কীভাবে এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, সরকারের কাছ থেকে যদি নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় তবেই ফিরে যাব। তবে তেমন হবে, এমনটি আশা করছে না রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বুচিদং থেকে কুতুপালং এলাকায় অনুপ্রবেশকারী মোঃ শাকের অবশ্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক তাণ্ডবে তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি খানিকটা আত্মসমালোচনাও করলেন। ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যেও কিছু সন্ত্রাসী থাকতে পারে। বর্মী সরকার তাদের বেছে বেছে মেরে ফেলুক। আমরা এবং আমাদের মা-বোন ও সন্তানরা তো অপরাধ করিনি। ওরা আমাদের কেন মারছে? আপনারা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা কর্ম করে খাই। এতসব দলের নামও জানি না। ষাটোর্ধ রহিমা খাতুন নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসেছেন গত বৃহস্পতিবার। এখনও তেমন খাওয়া-দাওয়া জোটেনি। বয়স হয়েছে, তাই ধাক্কাধাক্কি করে খাদ্য সংগ্রহ করা তার পক্ষে কঠিন। বললেন, ‘বা-জিরে কুয়ালে কি আছে ন জানি। পরাণ বাঁচাইতে আস্যমদে।’ অর্থাৎ কপালে কী আছে জানি না, প্রাণ বাঁচাতে এসেছি। প্রতিবেশী প্রায় সকলেই চলে এসেছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, নিজ বাড়িঘরে আর ফিরতে পারব এমন আশা নাই। মোকতার নামের আরেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী জানান, চাকরি বাকরি বা ব্যবসা না থাকলেও পরিশ্রমের কারণে তিনি ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল। নয়টি গরু ছিল। কৃষিকাজ করে চলছিলেন। কিন্তু সব শেষ। ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কোন সম্পদ আনতে পারেননি। আতঙ্ক সব সময় ছিল, কিন্তু এমন হবে কল্পনাও করিনি। পরিস্থিতি যদি জন্য কোনদিন ঠিক হয় তাহলে অবশ্যই ফিরে যাব। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় নব্বই সালের পূর্বে বলতে গেলে তেমন জনবসতি ছিল না। এরপর ১৯৯১-১৯৯২ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়লে সৃষ্টি হয় অস্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠিত হয় রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প। আর একে কেন্দ্র করেই মূলত এলাকাটি জনবহুল স্থানে পরিণত হয়। গড়ে ওঠে বাড়িঘর, দোকানপাট এবং মার্কেট। এরপর দেশী-বিদেশী এনজিও এবং বিভিন্ন খাদ্য সংস্থার তৎপরতায় এই এলাকা ধীরে ধীরে জমজমাট রূপ ধারণ করে। অতিসম্প্রতি আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়ায় অনুপ্রবেশকারীরাই এখন সংখ্যাগুরু। আর সে কারণেই স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আতঙ্কও পরিলক্ষিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের এবারের ঢলটা বেশ ব্যাপক। কুতুপালং থেকে বালুখালী, থাইংখালী এবং হোয়াইক্যং হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে এখন শুধু তারাই। প্রতিটি বাজারে তীব্র যানজট। রোহিঙ্গারা অস্থায়ী আবাসন গড়ছে সড়কের পাশে এবং বিভিন্ন ধরনের অনাবাদি জমিতে। এ অবস্থায় ওই সকল স্থানে তারা স্থায়ী হযে যায় কিনা সে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বালুখালী এলাকার বাসিন্দা মোঃ আলী জানান, সড়কের পাশে তার একটি জমিতে বাঁশ এবং পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তিনি শাকসবজির চাষ করেন। এখন যদি এরা না সরে, তাহলে তার আয়ের উৎসটা বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায় কিনা। কারণ, আয় উপার্জনহীন লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে। আরাকান থেকে আসা নারীরাও জড়াতে পারে নানা অসামাজিক কাজে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও যদি এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তো সর্বনাশ। বালুখালী এলাকায় স্থাপিত হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের এক সদস্য বলেন, আমরাও আশঙ্কা বিবেচনা করে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। কারণ তারা ইতোপূর্বে অস্ত্রে লুটের ঘটনাও ঘটিয়েছে। তাই অস্ত্রগুলো সুরক্ষিত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলায় এখন জনসংখ্যার বাড়তি চাপ। ফলে ভোগ্যপণ্য দুষ্প্রাপ্য হওয়ার পথে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় চালের কেজি প্রায় ৭০ টাকা ছুঁয়েছে। এমনকি এক প্যাকেট চিপস বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়। পানীয় জলের ছোট একটি বোতল কিনতে হচ্ছে ২০ টাকায় এবং তাও কয়েকটি দোকান খোঁজ করে স্থানীয়রা টাকার বিনিময়েও শাকসবজি পাচ্ছেন না। এদিকে একসঙ্গে এত রোহিঙ্গা এসে পড়ায় পরিবেশের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাদের বাসস্থান তৈরির জন্য ব্যাপক হারে কাটা হচ্ছে বাঁশ এবং বিভিন্ন ধরনের গাছ। তাছাড়া যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের কারণে পরিবেশ হয়ে পড়েছে দুর্গন্ধময়। সব মিলিয়ে এক ধরনের বিরূপ অবস্থা, যা ইতোপূর্বে প্রত্যক্ষ করা যায়নি।
×