ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাদপ্রতিম প্রীতি সংস্কৃতির শিকড়ে

বাঙালী জীবনে উৎসব আনন্দের সকল অনুষঙ্গে মিষ্টি

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালী জীবনে উৎসব আনন্দের সকল অনুষঙ্গে মিষ্টি

সমুদ্র হক সন্দেশ অর্থ সংবাদ। গোপাল গোল্লা হলো রসগোল্লা। দিল্লীর লাড্ডু প্রবাদে। মিষ্টিপ্রীতি। বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতির প্রবাদপ্রতিম। ভাল খবরে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠতেই অদৃশ্য সঙ্কেত দেয় মিষ্টি। বাঙালীর জীবনের আনন্দের সকল অনুষঙ্গেই মিষ্টি বাধ্যতামূলক। ঐতিহ্যের এই মিষ্টি সংস্কৃতি আর কোথাও নেই। রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশের কথাই আলাদা। ১৮শ’ শতকের প্রথমে মিষ্টির বংশে যোগ হয়েছে দই বা দধি। এসব মিষ্টি নিয়ে কতই যে কথা! সবচেয়ে মজার বিষয় হলো মিষ্টান্ন সন্দেশের আভিধানিক অর্থ ‘সংবাদ’ (নিউজ, ইনফরমেশন, মেসেজ, রিপোর্ট)। ‘ডিলিশিয়াস সুইটমিট মেড বাই পোসেট’ এই অর্থটি এসেছে অনেক পড়ে। হিন্দী ভাষাতেও সংবাদকে বলা হয় সন্দেশ। সেই সন্দেশ কি করে জিভেয় জল আসা মিষ্টান্ন হয়ে গেল এর ব্যাখ্যা পাওয়া বেশ কঠিন। পৌরণিক কাহিনীতে আছে কয়েক হাজার বছর আগে গোয়ালারা গাভীর দুধ দুইয়ে সংরক্ষণ করার পর খার হয়ে গেলে তা দিয়ে খারখন্দ বানাত। সেই খারখন্দই সন্দেশে পরিণত হয়। বাঙালীর মিষ্টি প্রীতির ধারায় একটা সময় সন্দেশ থেকেই তৈরি হতে থাকে নানা জাতের মিষ্টি। এত মিষ্টির মধ্যে সন্দেশের আভিজাত্য আলাদা। প্রাচীন আমলে বেসন নারকেল মুগ ও বুটের ডালের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে সন্দেশ বানানো হতো। কালের পরিক্রমায় দুধ ফেটিয়ে ছানা বানিয়ে তারপর নানা ধরনের সন্দেশ বানানো হয়। ক্ষীর দিয়েও তৈরি হয় সন্দেশ। নারিকেলের সঙ্গে চিড়া মিশিয়ে ক্ষীরের প্রলেপেও তৈরি হয় সন্দেশ। কোজাগরি পূর্ণিমার রাতে প্রণয়কে পাকাপোক্ত করতে প্রেমিক- প্রেমিকারা আজও সন্দেশ আপ্যায়ন করে। বাঙালী ময়রারা ছানা দিয়ে অনেক জাতের সন্দেশ বানায়।নরমপাক, কড়াপাক, শক্তপাক কাঁচাগোল্লা, চন্দন ক্ষীর কদম, মনময়ূরী, ইলিশপেটি, প্রাণহারা, পদ্মসন্দেশসহ এমন সব সন্দেশ যার স্বাদ দেশী-বিদেশী মিষ্টিপ্রেমীদের মুখে লেগে থাকে। এরপর দক্ষিণাঞ্চলে শীতের সময়ে পাটালি গুড়ের সন্দেশ আরেক মাত্রা যোগ করে। সন্দেশের অগ্রযাত্রা থেমে নেই। অষ্টাদশ শতকে চিনির সিরায় ছানা গোল করে চুবিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা। রসে টইটুম্বুর বাঙালীর রসগোল্লার বৈচিত্র্য কম নয়। রসগোল্লার পুরনো নাম গোপাল গোল্লা। গোপালকে সিরায় ডুবিয়ে হয়েছে রসগোল্লা। এর চারধারে ভিড় করে থাকে পানতোয়া চমচম কালোজাম রসমালাই রসমঞ্জুরি মন্ডা ইত্যাদি। ভারতবর্ষের প্রথম দিকের গবর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর নামেও ময়রা একটি বিশেষ রসগোল্লা বানায়। নাম দেয়া হয় লেডিকেনি। এই রসগোল্লা মিষ্টির বাজারে রাজার সিংহাসনে বসে। বাকিগুলো মন্ত্রী উজির নাজির পাইক পেয়াদা। প্রাচীন মিষ্টি হিসেবে এসেছে লাড্ডুর নাম। কেউ বলেন, ভারতবর্ষে প্রায় তিন হাজার বছর আগে এসেছে মতিচুরি লাড্ডু। বেসন দিয়ে ক্ষীরের মতো দানাদার করে বুন্দিয়া বানাবার পর শক্ত গোলাকৃতি করে যা হয় তাই মতিচুরি লাড্ডু। এই লাড্ডু ছিল মুঘলদের প্রিয়। আজও লাড্ডুর একছত্র আধিপত্য নিয়ে আছে দিল্লী। লাড্ডু হয়েছে প্রবাদের অংশ। ‘দিল্লী কা লাড্ডু জো খায়া ওভি পাস্তায়া জো নাহি খায়া ওভি পাস্তায়া’ এই প্রবাদটি উপমা হিসেবে এতটাই জনপ্রিয় যে বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে মিষ্টি নিয়ে এত মাতামাতি তার অন্যতম উপাদান ছানা উপমহাদেশে তৈরি করা শিখিয়েছে পর্তুগীজরা। প্রাচীন আমলে কোন একসময়ে দুধের ছানা ছিল পরিত্যাজ্য। ফেলে দেয়া হতো। বৈদিক যুগে দুধ থেকে তৈরি খাবার ছিল পৌরণিক ধারার অংশ। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতশিল্পী অনুপ জলোটার কণ্ঠে ননী মাখন ছানার গল্প নিয়ে ভজন আছে। পর্তুগীজদের পর বাঙালীরাই ছানা থেকে একের পর এক দুগ্ধজাতীয় খাবার বানাতে থাকে। শুরুতে এদের বলা হতো হালুইকর। পরে নাম হয় ময়রা। আজও এই নামেই তারা পরিচিত। ইতিহাসবিদগণের মতে, পাঁচ হাজার বছর আগে ঢাকার কাছে বিক্রমপুরে দুগ্ধজাত মিষ্টির আবির্ভাব ঘটে। আজও বলা হয় বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর হাটে মেলে খাঁটি মিষ্টি। সেই মিষ্টি এখন দেশজুড়ে। বাঙালীর মিষ্টিপ্রেমের কথা ফুরোবে না। পরীক্ষার ফলাফল, নতুন চাকরি, প্রমোশন, বিয়ে, নবজাতকসহ জীবনের আনন্দের অনুষঙ্গ শেয়ার করতে মিষ্টি আপন গতিতে চলে আসে। আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গেলে এখনও মিষ্টি নেয়া হয় প্যাকেটে করে। আগে নেয়া হতো মাটির হাঁড়িতে ভরে। মিষ্টির খ্যাতিও আছে অঞ্চল ভেদে। যেমন পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি ইত্যাদি। হালে বগুড়ার সরার দই ও যশোরের পাটালি গুড়ের সন্দেশ মিষ্টি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উৎসবে পার্বণে আনন্দে মিষ্টিমুখ না করালে বাঙালীর আতিথ্যের ষোলো কলা পূর্ণ হয় না। এদিকে মিষ্টির অগ্রযাত্রায় বগুড়ার সরার দইও আসন করে নিয়েছে। প্রাচীন নগরী বগুড়ার মহাস্থানগড়ে পর্যটকরা এসে ফিরে যাওয়ার সময়ও নিয়ে যান দই। আবার বগুড়া থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় দই নিতেই হবে। বগুড়ার দইয়ের মূল ঠিকানা জেলা শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। সুখ্যাতি এনে দিয়েছেন গৌর গোপাল চন্দ্র ঘোষ (প্রয়াত)। সরার দইয়ের উৎপত্তি সরভাজা থেকে। অর্থাৎ দুধ ঘন করে জাল দিয়ে যে সর হয় তা শুকিয়ে ভেজে সুস্বাদু করা হয়। এই সরভাজা থেকে মাটির সরায় দই ভরানো শুরু হয়। সেই থেকে সরার দই। হালে সরার দইয়ের পাশাপাশি খুটি ও বাড়কিতেও দই ভরানো হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিনি ছাড়া (ডায়েট) দই বানানো হচ্ছে। বাঙালীর মিষ্টান্ন প্রীতির ঐতিহ্যের প্রমাণ মেলে বরেণ্য কথাশিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রন্থে। এক গল্পে বর্ণনা করেছেন, বাংলাদেশের রসগোল্লা ইটালিতে নিয়ে গিয়ে কিই না বিপাকে পড়েছিলেন। রোম বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা রসগোল্লা দেখে তো বুঝতেই চাইছিলেন না খাবার দ্রব্য। হৈচৈ আর লঙ্কাকা-ের পর কর্মকর্তারা রসগোল্লার স্বাদ পেয়ে কতটা সাবার করেছিলন তা অবশ্য লেখেননি। তবে মিষ্টির সিরা যে কর্মকর্তাদের পোশাকে এঁটে গিয়েছিল তা বুঝিয়েছেন ইঙ্গিতে।
×