ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী

‘তুমি জন্মেছিলে বলে, জন্মেছে এই দেশ মুজিব তোমার আরেক নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।’ বাঙালীর আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক। বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অহর্নিশ নিজ চোখে অবলোকন করেছেন মানুষের দুঃখ-বেদনা, তৎকালীন শাসকদের অন্যায়-অবিচার। জীবনের সোনালি ১৪টি বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রদান করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণ বুকে নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালী সশস্ত্র হয়েছিল, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। বেদনাবিধুর আগস্ট মাস, বাঙালী জাতির জীবনে নিকষ কালো অধ্যায়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাঁদের তিন সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, দশ বছরের শিশু শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের ও নিরাপত্তা কর্মীসহ ১১ জনকে ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঘাতকরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় হত্যাকান্ড- থেকে বেঁচে যান। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর ইতিহাসের সকল নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। নারী, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, পঙ্গু ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। ঘাতকদের গুলিতে ১০ বছরের শিশু রাসেলের চোখ ও মাথার মগজ বেরিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতা শেখ নাসের পানি পানি বলে আকুতি জানালে তাকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। শেখ রাসেল ‘মায়ের কাছে যাব’ বলে কান্নাকাটি করলে একজন ঘাতক তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে বলে। অতঃপর শিশু রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। যে ঘাতক রাসেলকে মায়ের কাছে নিতে বলেছিল সেই ঘাতকই কিছুক্ষণ আগে বেগম মুজিবকে হত্যা করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ নির্ভীকতার সঙ্গে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এই নৃশংস হত্যাকা-ের সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ খুনীদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনীদের বলেছেনÑ ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের খেলা শুরু হয়। খুনী মোশতাক নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে, ২০ আগস্ট মার্শাল ল’ জারি করা হয়। ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত করে। ১৯৭৫সালে ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার, অবৈধ ও স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ- ৫০/১৯৭৫ জারি করে। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ রয়েছে, প্রথম অংশে বলা হয়েছে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুকনা কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। ৩ নবেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দেয়। সে সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রধান বিচারপতি সায়েম। জিয়াউর রহমান ’৭৭ সালের ২২ এপ্রিল অস্ত্রের মাধ্যমে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। ‘At Bangabhaban, last phase’ গ্রন্থে জাস্টিস সায়েম এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলেছেন। অতঃপর জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ’৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ-না গণভোটের আয়োজন করে, ’৭৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান যার প্রমাণ জিয়াউর রহমান নিজেই দিয়ে গেছেন, ’৭৯ সালে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স সংযুক্ত করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সুরক্ষা দিয়ে। কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারে সোপর্দ না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করে। ১২ জন ঘাতককে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। ১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব ২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব ৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজিরিয়ায় প্রথম সচিব ৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব ৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব ৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব ৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব ৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব ৯. কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব ১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব ১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব ১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান কর্তৃক পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত হওয়ার ফলেই বঙ্গবন্ধুর খুনীরা সদম্ভে খুনের কথা স্বীকার করে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়েছে। ২৬.০৫.১৯৭৬ সালে খুনী সৈয়দ ফারুক রহমান ’৭৫-এর আগস্টের হত্যাকা-ের ব্যাপারে সানডে টাইমস পত্রিকার (১১নং পৃষ্ঠায়) একটি বিবৃতি প্রদান করে, যার শিরোনাম-‘I helped to kill Mujib, dare you put me on trail. ’ বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের কাছে সাক্ষাতকারে খুনী ফারুক ও রশিদ বলেছে, একজন ’৭৫ সালের মার্চ মাসে আরেকজন হত্যাকা-ের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৩ আগস্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। জিয়াউর রহমান তাদের বলেছে, তিনি সিনিয়র, এই কাজে অংশ নিতে পারবেন না কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের বাধা দেয়নি বলেছে ‘এড় ধযবধফ’ এই সাক্ষাতকার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দীতে ১। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে ফলে খুনীরা সুরক্ষা পায়। খুনীদের বিচারে সোপর্দ না করে পুরস্কৃত করে, বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দেয় ও খুনীরা দম্ভভরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার কথা স্বীকার করে। ২। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কর্নেল (অব) শাফায়াত জামিল বিচার আদালতে সাক্ষ্য দেন, ১৫ আগস্ট সকাল অনুমান ৬টায় মেজর রশিদ তাকে বলে- ‘We have captured state power under Khandakar Mustaque, Sheikh is killed, do not try to take aû action against us.’ এ কথা শুনে শাফায়াত জামিল হতচকিত হন। দ্রুত ইউনিফরম পরে হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যান এবং তাকে শেভরত অবস্থায় পান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের খবর শুনে জিয়াউর রহমান শাফায়াত জামিলকে বলেন, ‘So what president is killed... .’ ৩। খুনী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলে, ‘...এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই..., আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তোমরা করতে পারলে কিছু কর।’ পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলে, ‘এ বিষয় নিয়া তোমাকে চিন্তা করতে হবে না... আমি deal করব।’ রশিদ পরে জিয়া এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বেনিফিশিয়ারি জিয়া ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাকা-ের আর্কিটেক্ট বিখ্যাত সাংবাদিক Lawrence Lifschulty-এর একটি উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য- ‘Ziaur Rahman was passively involved in the assassination of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman. ’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তার মধ্যে- ১। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের তদন্তে যুক্তরাজ্যে যে অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয়েছিল তার সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি জেফরি টমাস ও তার সহকারিকে ’৮১ সালে বাংলাদেশে আসতে বাধা দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। ২। বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দেয়ার কারণে জার্মানে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ওএসডি করেছিল। ৩। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর কন্যাদের দেশে আসতে দেয়নি জিয়াউর রহমান। কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার মেয়াদ উত্তীর্ণ পাসপোর্ট যাতে নবায়ন না করে তার জন্য লন্ডন দূতাবাসকে অফিসিয়ালি নির্দেশ দেয়া হয়। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার পাসপোর্ট নবায়ন করায় ভারতে নিযুক্ত সেই সময়ের রাষ্ট্রদূতকে চাকরিচ্যুত করে। ৪। ’৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে (যা বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণয়ন করেছিল), কারাগারে আটক ও দ-িত সকল যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়, ’৭৬ সালে সেকেন্ড প্রক্লেমেশন অর্ডার নং-৩/১৯৭৬ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেয়। সেকেন্ড প্রক্লেমেশন ঘোষণা জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নম্বর-ক ১/১৯৭৭ জারি করে দালালদের সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নম্বর-১/১৯৭৭ দ্বারা সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। ৫। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানায়। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সকল বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ওই সব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে উৎখাত করে। বঙ্গবন্ধু ’৭৩ সালে ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম গংয়ের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ’৭৮ সালে গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনে। জিয়াউর রহমান ’৭৭ সালে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের বেছে বেছে হত্যা করে। প্রতিরাতে কার্ফু দিয়ে মানুষ হত্যা করা হতো ওই সময়। ৬। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার নেতৃত্বের ইতিহাস নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু শব্দের প্রতিও জিয়াউর রহমানের ভীতি ছিল। জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়াÑ বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি জেনারেল এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করিয়ে খুনীদের প্রটেকশন দেয়, বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে। জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ’৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সকল হত্যাকারীকে পদোন্নতি দেয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কালো দিন, ’৯৩ সাল থেকে খালেদা জিয়া এই বেদনাবিধুর দিনে মিথ্যা জন্মদিন পালন করে, কেক কাটে, এই বর্বরতম কাজ করে খালেদা জিয়া মূলত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বুকে ছুরি চালায়। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনী রশিদ এবং হুদাকে এমপি বানায় খালেদা জিয়া। খুনী রশিদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বানিয়ে সংসদকে কলুষিত করে খালেদা জিয়া। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত ও মামলা পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগীদের অনৈতিক ও বেআইনী কার্যকলাপ : আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যার ৩ মাসের কম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। ইন্ধিরা গান্ধী হত্যার ৪ বছরের কম সময়ের মধ্যে, মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার ২ বছরের কম সময়ের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিচারের বাণী কেঁদেছিল, বিচারহীনতার সংস্কৃতি পাথরের মতো চেপে বসেছিল, বিশ্ব সভ্যতায় বাঙালী জাতির ললাটে এঁকে দিয়েছিল কলঙ্ক তিলক। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর এবং ৩৪ বছর পর কার্যকর হয়েছে রায় তবে এখনও কয়েক খুনী পলাতক। মূলত ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত গণতন্ত্র বন্দী ছিল, আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত। ’৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর সংসদে আইন পাস করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করা হয়- যাত্রা শুরু হয় কলঙ্ক মোচনের। ’৯৬ সালের ১২ নবেম্বর সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রহিতকরণকল্পে বিল আনয়ন করা হয় সেদিন বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল। প্রশ্ন ওঠে, কেন তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল? জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেনি, আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া দায়রা জজ আদালত কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন হরতাল পালন করেছে। ২০০১-এর অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। আইনের চলমান প্রক্রিয়া বন্দী হয় রাজাকারের প্রকোষ্ঠে, শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদদের কাছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার উচ্চ আদালতের চলমান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। অতঃপর ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে সুপ্রীম কোর্ট। আপীলকারী ৫ আসামির আপীল খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রাখে সুপ্রীম কোর্ট। আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দী আসামিদের সাজা কার্যকর করা হয়। জাতি কলঙ্ক থেকে আংশিকভাবে মুক্ত হয়। বস্তুত আমাদের লড়াইটি এখনও রয়ে গেছে। পালিয়ে থাকা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৬ খুনীদের দন্ড- কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাঙালীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটতেই থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করতেই খুনীরা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ করেছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, শিশু শুকান্ত বাবুকে হত্যা করে মানবতার বুকে কুঠারাঘাত করেছে। খুনীরা শুধু একজন নেতাকে নয়, জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। একটি আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছে। খুনীর দল জানেনা আদর্শকে হত্যা করা যায় না, স্বপ্নকে হত্যা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু অমর, অব্যয়, অক্ষয়। এই নৃশংস ঘটনায় রাষ্ট্র তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি, বিচারের পদক্ষেপ নেয়নি; বরং খুনীদের পুরস্কৃত করে, দায়মুক্তি দিয়ে সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছিল খুনীর রাষ্ট্রে। এই জঘন্য হত্যাকা-ের মদদদাতা ও রক্ষা কর্তাদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। বাঙালীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা অগাধ, যার সন্ধান পাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে-‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা।’ বাঙালী জাতির প্রতি এই অক্ষয় ভালবাসাই- পাকিস্তানের মিয়াওয়ালির কারাগারে ভুট্টো-ইয়াহিয়া যে কবর খুঁড়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য, বাঙালীর প্রতি সেই ভালবাসার এমনই অপার শক্তি যা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ইপ্সিত লক্ষ্য থেকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন। শেষ করব ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির একটি মন্তব্য দিয়ে, ‘আজও আমি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালী হিসেবে তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। নিজের জাতি সত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমার প্রথম শিক্ষা।’ এই শিক্ষা আমাদের জীবনে পাথেয় হতে পারে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, ষড়যন্ত্র ও ইতিহাস বিকৃতি থেকে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে, স্বপ্ন দেখাতে পারে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক : আইনজীবী ও সংসদ সদস্য
×