ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী আখ্যা দিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে

ইতিহাস বলছে রোহিঙ্গারা ৫শ’ বছরের বেশি আরাকানের বাসিন্দা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ইতিহাস বলছে রোহিঙ্গারা ৫শ’ বছরের বেশি আরাকানের বাসিন্দা

শাহীন রহমান ॥ ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী। বাঙালী আখ্যা দিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করা হলেও জাতিগতভাবেই তারা আরাকানে বসবাস করে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে রোহিঙ্গারা ৫শ’ বছরের বেশি সময় ধরে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছে। অথচ বাঙালী এবং বাংলাদেশ থেকে আসা অভিযোগের ধুয়া তুলে তাদের বিতাড়িত করতে বর্বর-পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বাদ পড়ছে না নারী-শিশু। বিশ্বের মুসলমানরা যখন পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ঈদ- উল-আযহা উদযাপনে ব্যস্ত ঠিক তখনও রোহিঙ্গাদের ওপর চলছে অকথ্য নির্যাতন। ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে আরাকান ছিল স্বাধীন মুসলিম রাজ্য। এই সময়ই আরাকান সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৪০৪ থেকে ১৬১২ সাল পর্যন্ত ১৬ মুসলিম সম্রাট আরাকান শাসন করেছেন। কিন্তু রাজ্যের দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে বর্মার রাজা বোধাপোয়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখল করে বর্মার সঙ্গে যুক্ত করেন। কিন্তু ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে বর্মা সরকার আরাকান, অসম এবং মনিপুরের ওপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ইউনিয়ন অব বর্মা স্বাধীনতা অর্জন করলে আরাকান বর্মার অংশ হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার সরকার বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত ধুয়া তুলে নির্যাতন শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরাকান রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ অঞ্চল। ১৮ হাজার ৫৪০ বর্গমাইল আয়তনের আরাকান রাজ্যটি বর্তমান মিয়ানমারের ৭টি রাজ্যের অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভূরাজনৈতিক নৈকট্যের কারণে আরাকানের জনগণের সঙ্গে এদেশের জনগণের গভীর সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বন্ধনের সূত্রপাত ঘটেছিল। বাংলার জনগণ এবং আরাকানের বৌদ্ধরা সম্প্রীতি এবং বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল সহাবস্থান করেছেন। একে অপরের সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা- বিকশিত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাদের মতে, এক সময় ছিল যখন চট্টগ্রাম ছিল আরাকানের সঙ্গে সংযুক্ত। এবং আরাকানের অংশবিশেষ ছিল চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার বাংলাদেশের গণতন্ত্র বইতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, বার্মাদেশের চাইতেও আরাকান সব সময় ভারত এবং বাংলাদেশের মতো পশ্চিম ও উত্তরের অঞ্চল ও সংস্কৃতি দিয়েই প্রভাবিত হয়ে এসেছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উভয়দিক দিয়েই আরাকান ছিল বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে ইসলামের অভিযাত্রা অন্য এলাকার মতো আরাকানে এসে আঘাত হানে। বাংলাদেশ এবং অসমসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাংশের দিকে এই অভিযাত্রা জোরদার হয়। ফলে এই এলাকার বিরাটসংখ্যক জনগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। আরাকানে বৌদ্ধ এবং রাজন্যবর্গ এ বিষয়ে নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেন। এ সময় উভয় ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর জোর দেন। এমনকি এক সময় বৌদ্ধভিক্ষু এবং সম্রাটদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে যখন আরাকান ভেঙ্গে টুকরা হয়ে যাচ্ছিল তখন রাজ্য প্রশাসনে আরাকানের মুসলিম জনগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক পর্যায়ে আরাকান বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও বিকশিত হতে থাকে। বিভিন্ন সময় অসংখ্য কবি এবং সাহিত্যিককে আরাকানে নিমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। এসব কবির মধ্যে যুগশ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওল অন্যতম। এক সময় আরাকানের রাজদরবারের ভাষা ফার্সি হলেও সংস্কৃত ও উর্দু ভাষাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হতো। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরাকানী মুসলমানরা বসবাস করে এলেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নে উইন সরকার ১৯৮২ সালে প্রণীত এক আইনবলে সেদেশের জাতীয় পরিচয় থেকে বাদ দেয় আরাকানী মুসলমানদের। এই আইনে রোহিঙ্গাদের এক ধরনের বিদেশী এবং রাষ্ট্রহীন এক জাতিতে পরিণত করা হয়েছে। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সুযোগ পেলেই তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে বাঙালী জাতিগোষ্ঠীর ধুয়া তুলে। তাদের নির্মূল করার জন্য চালানো হচ্ছে গণহত্যা। তাদের বিতাড়ন করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরাকানের ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা মুসলিম এবং ২৫ শতাংশ বৌদ্ধ অধ্যুষিত হওয়ার কারণে ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন খাতে মোড় দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা আরাকানী বা মুসলমান যাই হোক না কেন তারা হলো বর্মার অধিবাসী। তাদের বাংলাদেশে বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু করায় অর্থনৈতিক এবং সীমানাগত নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। অথচ বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর খাবার এবং আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আরাকানের নিরস্ত্র, নিষ্পাপ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ওপর সেদেশের সেনাবাহিনী নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এ কারণে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আরাকানী মুসলমানরা সর্বপ্রথম শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এরপর থেকে একাধিকবার রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের এই অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে দুবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। বর্তমানে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। পুরুষ ধরে নিয়ে নৃশংস নির্যাতন করে হত্যা করা হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না শিশুও। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এরা যাতে আর তাদের বাড়িঘরে ফিরে যেতে না পারে সেজন্য সীমান্তে মাইনও পুঁতে রাখা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মিয়ানমারের দখলের আগে আরাকান ছিল স্বাধীন একটি প্রাচীন রাজ্য। আর আরাকান রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল চট্টগ্রাম পর্যন্ত। আরাকানে বসবাসকারী মগ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খান এক অভিযানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে তাদের বিতাড়ন করেন। মগ জলদস্যু হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাখাইনরা এক সময় তাদের দোসর পর্তুগীজদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরে লুটতরাজ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে শায়েস্তা খান তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এবং তাদের বাংলাদেশ সীমানা থেকে বিতাড়িত করেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নির্বাচনের আগে আউং সান সুচির প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি গণতন্ত্রের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করবেন। কিন্তু সুচির সে প্রতিশ্রুতি এখন সুদূরপরাহত। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে মিয়ানমারের বর্তমান সেনাবাহিনীর একটি অংশও মনে করে, মিয়ানমারে নির্বাচন হলেও রাখাইন রাজ্যে তাদের কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এ অসমাপ্ত কাজটি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের সে অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা। বর্তমানে সেই প্রকল্প নিয়ে সেনাবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে।
×