ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যাবের ধারণা- হামলার পরিকল্পনা ছিল

মিরপুরের আস্তানা থেকে আরও বিস্ফোরক, ভবনের নক্সা উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিরপুরের আস্তানা থেকে আরও বিস্ফোরক, ভবনের নক্সা উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বৃহস্পতিবারও মিরপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে আরও বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। সেইসঙ্গে উদ্ধার হয়েছে একটি বহুতল আলিশান ভবনের নক্সা। নক্সার বিভিন্ন জায়গায় মার্কিং করা। ভবনটিতে হামলা চালাতে বা উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে র‌্যাব ধারণা করছে। এদিকে আস্তানাটিতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহতদের সুরতহাল সম্পন্ন হয়েছে। নিহতরা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে আব্দুল্লাহর লাশ নিতে রাজি হয়নি তার পরিবার। এ ঘটনায় আটক বাড়ির মালিক ও নৈশপ্রহরীকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে র‌্যাব। আব্দুল্লাহর সঙ্গে কামাল নামে একজন নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে এক পরিবার। কামালের পিতামাতা আস্তানার সামনে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তাদের ছেলে আব্দুল্লাহর কর্মচারী হিসেবে সেই বাসায় থেকে কাজ করত। যদিও র‌্যাব বলছে, আব্দুল্লাহর দুই সহযোগীর পরিচয় এখনও নিশ্চিত নয়। ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে। আস্তানা থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর দারুস সালাম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই যথারীতি আবার আস্তানায় অভিযান শুরু করে র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অভিযান স্থগিত ঘোষণা করা হয়। আজ শুক্রবার আবার অভিযান শুরু হবে। অভিযানে অংশ নেয়া র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, বুধবার রাতে অভিযানকালে আস্তানায় কিছু বিস্ফোরকের অস্তিত্ব মেলায় অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবারের অভিযানে আস্তানায় আরও কিছু বিস্ফোরক থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। আস্তানায় শক্তিশালী বোমা রয়েছে। সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। বৃহস্পতিবার আস্তানায় থাকা কার্টনের ভেতর থেকে আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস), কবুতরের খাবার ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। অভিযানের একপর্যায়ে বিকেলে আস্তানাটি থেকে একটি বহুতল আলিশান ভবনের নক্সা ও নক্সা অনুযায়ী ভবনটির একটি স্ট্রাকচার উদ্ধার হয়েছে। নক্সা ও স্ট্রাকচারে নানা ধরনের অর্থবহ মার্কিং করা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ ভবনটিতে তারা হামলা চালানো অথবা ভবনটি উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তবে সেই ভবনটি কোথায় বা কোন ভবন তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। সেটি জানার চেষ্টা চলছে। সে কারণেই ওই আস্তানায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অভিযান স্থগিত করা হয়। ভবনটিতে অভিযান চালানোর জন্য বাকি থাকা ষষ্ঠ তলায় শুক্রবার অভিযান চালানো হবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে জঙ্গী আস্তানায় নিহত সাত জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন কলেজটির সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ, ডাঃ প্রদীপ বিশ্বাস ও ডাঃ কবির সোহেল। পরে ডাঃ সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, আগুনে পুড়ে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। বোমা বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। মৃতদেহগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। হাড়-মাংস কিছুই ছিল না। অনেক কষ্টে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মেরুদ-ের সামান্য হাড় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া শরীরের ধংসাবশেষ থেকে লোহার টুকরো, দস্তা ও টিনের টুকরো সংগ্রহ করা হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নিহতদের বয়স জানার কোন উপায় নেই। এমনকি কে নারী আর কে পুরুষ তাও নির্ণয় করা যাচ্ছে না। শুধু দুটো শিশুর মৃতদেহ থাকার বিষয়টি বুঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে একজনের বয়স আড়াই থেকে ৩ বছর। আরেকজনের বয়স আট থেকে দশ বছর বলে ধারণা করা হচ্ছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, জঙ্গী আব্দুল্লাহর লাশ গ্রহণের জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারা লাশ নিতে রাজি হননি। এই র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, জঙ্গী আস্তানায় বিস্ফোরণের ঘটনার পর আটক বাড়ির মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ ও নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল সাভার থেকে তামিম দারি গ্রেফতারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, তামিম দারির আগের নাম গৌরাঙ্গ কুমার ম-ল। তিনি হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। তামিম দারি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লুৎফুল কবির জানান, বাড়িওয়ালা হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ ও নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলাম জঙ্গীদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রাথমিকভাবে এর সত্যতা মিলেছে। রিমান্ডে পাওয়া গেলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। বৃহস্পতিবার আস্তানার সামনে আব্দুল মালেক নামের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম এসে দাবি করেন, আব্দুল্লাহর সঙ্গে তাদের ছেলে কামাল উদ্দিন (২২) কাজ করত। তাদের বাড়ি ভোলায়। কামাল দুর্ধর্ষ জঙ্গী আব্দুল্লাহর কবুতরের খামারে কাজ করত। নূরজাহান বেগম বলেন, ৬ মাস ধরে আব্দুল্লাহর কবুতরের খামারে কাজ করছিল তার ছেলে। রাতে মিরপুর দিয়াবাড়ি এলাকার হরিরামপুরে বোনের বাসায় থাকত। ঈদের আগের রাতে তার ভোলার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। বলেছিল কোরবানির মাংস নিয়ে আসবে। কিন্তু শনিবার দিনের বেলায় জানায়, এখনও বেতন পায়নি। বেতন পেলে বাড়ি যাবে। আর আব্দুল মালেক বলেন, শনিবার রাত থেকেই কামালের ফোন বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার গণমাধ্যমের কল্যাণে আব্দুল্লাহর বাসায় র‌্যাবের অভিযানের কথা জানতে পারেন। কামাল গত রোজার ঈদে শেষবার বাড়ি গিয়েছিল। র‌্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান বলছেন, এমন দাবিকে তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কিন্তু এখনই তাদের পক্ষে আব্দুল্লাহর সহযোগী হিসেবে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে কামাল রয়েছে বলে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই আব্দুল্লাহর দুই সহযোগীর নাম জানা দাফতরিকভাবে জানা সম্ভব। আস্তানায় আব্দুল্লাহ ছাড়াও তার দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা, আব্দুল্লাহর দুই ছেলে ওমর ও ওসামা নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে বলে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত গভীর রাতে রাজধানী ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের বর্ধমান বাড়ির ২/৩/বি নম্বর ছয়তলা বাড়িটিতে জঙ্গী আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয় র‌্যাব। অভিযান চালানোর আগে বাড়িটির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ১৫ জন শিশু, ২৪ জন নারী ও ২৬ জন পুরুষ সদস্যকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় র‌্যাব। এরপর থেকেই র‌্যাব আস্তানায় থাকাদের আত্মসর্মপণ করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। জঙ্গী আব্দুল্লাহর প্রতিবন্ধী বোন মেহেরুন্নেছা আত্মসর্মপণ করেন। পরবর্তীতে আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে অন্যদের আত্মসর্মপণ করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় র‌্যাব। মঙ্গলবার আব্দুল্লাহ আত্মসর্মপণ করতে রাজিও হয়। শেষ পর্যন্ত আত্মসর্মপণ না করে রাত দশটার দিকে আত্মঘাতী হয়ে আস্তানায় ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গীরা। আস্তানা থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। বিস্ফোরণে চার র‌্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। বুধবার আস্তানা থেকে ৭টি মাথার খুলি ও পুড়ে একপ্রকার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরের বিভিন্ন পোড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্ধার করা হয়। ওইদিনই আব্দুল্লাহর ভাই খোকাকে ঢাকার মিরপুরের দিয়াবাড়ি থেকে আটক করে র‌্যাব। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, প্রচ- বিস্ফোরণে ঘরের মেঝে ধসে পড়েছে। ভেতরের সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। আর সেখানে থাকা সম্ভাব্য জঙ্গী আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের চারজন ও তার সহযোগী দুইজনসহ মোট সাত জন নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আব্দুল্লাহ ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। আর ২০১৩ সালে যোগ দেন নব্য জেএমবিতে। তার বাসায় জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়া হতো। জঙ্গীদের অর্থের যোগান দিতেন আব্দুল্লাহ। তার বাসায় জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীর যাতায়াত ছিল। বছরখানেক ধরে আব্দুল্লাহর সন্ধান চলছিল। আস্তানাটি আবিষ্কৃত হওয়ায় দেশ ও জাতি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাড়িটি ভাড়া নিয়ে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদ করেছিল।
×