ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আসছে স্রোতের মতো ॥ চাপ বাড়ছে ॥ রোহিঙ্গা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আসছে স্রোতের মতো ॥ চাপ বাড়ছে ॥ রোহিঙ্গা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য

হাসান নাসির, কক্সবাজার থেকে ॥ রোহিঙ্গারা আগে থেকেই আছে চার লক্ষাধিক। সাম্প্রতিক সহিংসতায় যুক্ত হয়েছে আরও অন্তত তিন লাখ। বাকিরাও সুযোগের অপেক্ষায়। ছোট্ট এই বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল। তার ওপর এত রোহিঙ্গা বোঝা বইবে কীভাবে? মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা এসেছে এবং আসছে স্রোতের মতো। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্যও। সম্পৃক্ত রয়েছে দালাল চক্র, মাঝি-মাল্লা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং জমজমাট ঘর ও জায়গা ভাড়ার ব্যবসা। এছাড়াও আছে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত অনেক এনজিও এবং সংস্থা। সব মিলে পর্যটনভূমি হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার জেলার ওপর এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে বাড়তি চাপ, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে। রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা নারী-শিশু এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশা এখন চরমে। সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতার জবাবে আগ্রাসী মিয়ানমার সেনা বাহিনী। তবে এর করুণ শিকার নিরীহরা। মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযানের মুখে তারা ভিটাবাড়িছাড়া। অভিযোগ, এরা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার শুরুতে কঠোরতা প্রদর্শন করলেও সীমান্ত এখন যথেষ্ট শিথিল বলেই প্রতিয়মান। অর্থাৎ ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারলে আর বের করে দেয়া হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর নেপথ্যের মূল নেতারা এমনকি যোদ্ধারাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ বাসিন্দাকে। রাখাইনের রোহিঙ্গা মুভমেন্ট সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এমন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম চললেও তাদের নেতারা থাকেন পাকিস্তান, সৌদি আরব এমনকি বাংলাদেশেও। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাদের হাতে বিভিন্ন উৎস থেকে এসে যায় মানবিক সাহায্য এবং অস্ত্র সহায়তার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সাধারণের জানমাল গেলেও এই নেতারা কোটি কোটি টাকার মালিক। এদিকে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক আনুকূল্য থাকলেও বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন কক্সবাজার জেলার মানুষ। তাদের মধ্যে অতটা আবেগ নেই, বরং রয়েছে উদ্বেগ। কারণ মূলত চাপটা পড়ছে কক্সবাজারবাসীর ওপর। যে সকল এলাকায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে বাঙালীরা। দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের, বৃদ্ধি পেয়েছে যাতায়াত ব্যয়। তবে পাশাপাশি মহল বিশেষের আয়ও বেড়েছে রমরমা কারবারে। রাতারাতি পাহাড়ের বন উজাড় করে বানিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি। উদ্দেশ্য, এককালীন কিছু আদায় এবং মাসে মাসে বাড়িভাড়া। টেকনাফ, উখিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের স্রোত এতটাই প্রবল যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য খালি হয়ে যাওয়ার পথে। এক অর্থে মিয়ানমার সরকার যা চায়, তাই হচ্ছে বলে অভিমত অভিজ্ঞ মহলের। এ নিয়ে রাজনীতি যেমন আছে তেমনি রয়েছে আর্থিক বিষয়ও। আগত নারী-শিশুদের জন্য সহানুভূতি থাকলেও ঘৃণাবোধ সেই সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর প্রতি, যারা একটি জনগোষ্ঠীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে তাদের নাগরিকত্ব না থাকলেও ঘরবাড়ি ছিল, গবাদিপশু এবং কৃষিকাজ ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে ব্যবসা এবং দালালি করে অনেকেই কোটিপতি। রোহিঙ্গা নেতারাও কোটি কোটি টাকার মালিক। তারা কেউ সেদেশে থাকেন না। অবস্থান করেন পাকিস্তান, সৌদি আরব, বাংলাদেশ এবং আনুকূল্য পাওয়া বিভিন্ন দেশে। মাঝে-মধ্যে গ-গোল লাগিয়ে দিতে পারলে তাদের বিশাল অঙ্কের আয় হয়। অর্থ এসে যায় বিভিন্ন দেশ এবং গোষ্ঠীর কাছ থেকে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যেমন রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পোড়াচ্ছে ঠিক একইভাবে রোহিঙ্গারাও বর্মী নাগরিকদের বাড়িঘর পুড়িয়েছে এমন তথ্য রয়েছে। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান আছে। এর মধ্যে কয়েকটি সংগঠন এখন অনেকটাই নমনীয়। স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করে তারা এখন নাগরিকত্ব এবং সমান অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে চায়। কিন্তু কট্টর সংগঠনগুলো চায় বিচ্ছিন্নতা। তাদের কারণে নির্যাতিত হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গা। সেদেশের সরকারের অভিযোগ, এরা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের শেল্টার দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের এই নেতা আরও বলেন, আমরা মানবিক বিবেচনায় শরণার্থীদের দিকটি দেখছি। কিন্তু এত বিশাল জনস্রোত যদি এদিকে আসতেই থাকে, তাহলে আমাদের দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ার পাশাপাশি কক্সবাজারের সামাজিক জীবনযাত্রায় ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হবে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে এদেশের অনেক দালাল, মাঝি-মাল্লা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। আর দেশে আনার পর এদের দিয়ে চলে নানামুখী বাণিজ্য। ইয়াবা থেকে শুরু করে অস্ত্র এবং ঘর ও জায়গা ভাড়া বাণিজ্য বেশ রমরমা। আবার এদের নিয়ে কাজ করছে কিছু এনজিও এবং সংস্থা, যারা দেশবিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া অর্থে পরিচালিত। এমন অনেক সংস্থা এবং চক্র রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের চায় নিজেদের স্বার্থেই। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছে ৭টি নিবন্ধিত এনজিও। এগুলো হচ্ছে এসিএফ, এমএসএফ, ইসলামিক রিলিফ, রিক, মুসলিম এইড, সলিডারিটি এবং হেন্ডিক্যাপ। বিদেশী সাহায্যপুষ্ট নিবন্ধিত এই সংস্থাগুলো ছাড়াও অনিবন্ধিত আরও সংস্থা রয়েছে। সংগঠনগুলো শরণার্থীদের খাদ্য নিরাপত্তা, নিউট্রিশন, স্বাস্থ্য সেবা, আশ্রয়ণ, শিশু ও বৃদ্ধাশ্রমসহ নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করে থাকে। নিবন্ধিত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সরকারী মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকলেও অনিবন্ধিত এবং ব্যক্তি উদ্যোগের কার্যক্রম চলছে নিজেদের মতো করে। কক্সবাজার জেলায় একদা নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্প ছিল দুটি। এগুলো হচ্ছে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া। তবে সাম্প্রতিক এত বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে যে, তারা রয়েছে যত্রতত্র। এদিকে দেশের অধিকাংশ মানুষের চাওয়া এবং কক্সবাজারবাসীর চাওয়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কেননা, এই অভিবাসনজনিত বাড়তি চাপ সইতে হচ্ছে তাদেরই। কক্সবাজারবাসীর বক্তব্য, দুর্দশাগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে আশ্রয় দেয়াটাই সমাধান নয়। বরং সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগে এই অভিবাসন ঠেকানো প্রয়োজন।
×