ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ড্র

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সমান সমান

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সমান সমান

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস দরজায় করাঘাত করছিল। দ্বার খুলে দিয়ে শুধু তাকে বরণ করার অপেক্ষাÑ বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো টেস্ট দল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম টেস্ট খেলতে এসেছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে পারেনি টাইগাররা মূলত ব্যাটিং বিপর্যয়ের কারণে। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে চারদিনেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭ উইকেটে পরাজয়কে বরণ করেছে বাংলাদেশ দল। অথচ এরআগে তিনবার সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকার পর কখনও সিরিজ হাতছাড়া হয়নি। ২০০৫ ও ২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ে এবং ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই কীর্তি দেখিয়েছিল টাইগাররা। এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই তিনটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির মোক্ষম সুযোগ এসেছিল মিরপুরে প্রথম টেস্ট জয়ের পর। কিন্তু সেটার ব্যতিক্রম ঘটল এবার। হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা ইতিহাস ধরা দেয়নি, তবে হারের পর অসিদের বিরুদ্ধে গৌরবে ভাসবার মতো অর্জন এসেছে। ১-১ সমতায় শেষ করেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় পাওয়া এবং সিরিজ ড্র করাটাকে অনেক বড় অর্জন হিসেবে দাবি করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। হরিষে বিষাদ হিসেবে শুধু থাকল সাগরিকার পরাজয়। এবার নিয়ে সপ্তমবারের মতো কোন টেস্ট সিরিজ ড্র করল বাংলাদেশ দল। এরআগে জিম্বাবুইয়ে (১-১, ২০১৩), নিউজিল্যান্ড (০-০, ২০১৩), ভারত (০-০, ২০১৫), দক্ষিণ আফ্রিকা (০-০, ২০১৫), ইংল্যান্ড (১-১, ২০১৬) এবং শ্রীলঙ্কার (১-১, ২০১৭) বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ ড্রয়ের গৌরব দেখিয়েছিল বাংলাদেশ দল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও সেই প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে। কিন্তু স্বপ্নটা ছিল ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের। সিরিজ শুরুর আগেই তেমন ঘোষণা দিয়ে অভিযানে নেমেছিলেন দলের ক্রিকেটাররা। বাস্তব হয়ে ওঠার অভাবিত ঘটনা ঘটে যায় মিরপুরে সিরিজের প্রথম টেস্টে ২০ রানে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের স্পিন তোপের কাছেই নতি স্বীকার করে অসিরা। যদিও আগের ১০১ টেস্টে মাত্র ১০ জয় আর ১৫ ড্র ছিল। কিন্তু ১-০ ব্যবধানে ৩ বার এগিয়ে যাওয়ার পর সিরিজ নিজেদের পক্ষেই রেখে দিয়েছিল টাইগাররা। এবারও সেটাই ঘটতে চলেছে এমনটা প্রায় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে হৃদয়ে গেঁথে যায় দেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রেমী ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। তবে মিরপুরের সেই লড়িয়ে মনোভাব, সেই আক্রমণাত্মক মেজাজে সাগরিকায় দেখা যায়নি মুশফিকদের। যেন ড্র করার লক্ষ্যেই খেলেছে বাংলাদেশ দল। সে কারণেই ললাটে আঁকা হয়েছে পরাজয়ের গ্লানি। তৃতীয়দিন বিকেলে দারুণ প্রত্যাবর্তন করেছিল অবশ্য বাংলাদেশ দল। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংবান্ধব উইকেট হলেও ৩০৫ রানেই থেমে গিয়েছিল ইনিংসটা। তখন নাসির হোসেন বলেছিলেন ১০০/১৫০ রান কম হয়েছে দলের। এর পেছনে খলনায়ক হিসেবে মূল ভূমিকায় হন্তারক হয়ে উপস্থিত ছিলেন ডানহাতি অফস্পিনার নাথান লিয়নÑ শিকার করেছিলেন ৭ উইকেট। বাংলাদেশের রান কম হয়েছে সেটা পরিষ্কার হয় দ্বিতীয়দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ২ উইকেটে ২২৫ রান করার পর। কোন বোলারই কার্যত প্রভাব ফেলতে পারেননি অসি ব্যাটসম্যানদের ওপর। তবে তৃতীয়দিন বিকেলে স্পিনটাই ভয়ানক হয়ে ওঠে আর নতুন বলে পেস স্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমান হয়ে ওঠেন বিধ্বংসী। আরও ৭টি উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। ফলে খুব বড় লিড নিতে পারেনি অসিরা। ৯ উইকেটে ৩৭৭ রান নিয়ে খেলতে নেমে চতুর্থদিন সকালে মাত্র ৮ মিনিট ও ১১ বলেই শেষ উইকেটটি দখল করে বাংলাদেশ মুস্তাফিজের দারুণ বোলিংয়ে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পেসার হিসেবে ৪ উইকেট শিকার করেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। মাত্র ৭২ রানের লিডেই থাকে অসিরা। খুব বেশি পিছিয়ে না থাকলেও নতুন করে স্পিনের প্রত্যাবর্তন শঙ্কার তৈরি করে। কারণ আবার সেই ৭ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান নিয়ে ডানহাতি অফস্পিনার লিয়নের মোকাবেলা করতে হবে। সেই শঙ্কাটা সত্যি হয়েছে বাংলাদেশ দল ব্যাটিংয়ে নামার পর। একে একে লিয়নের শিকারে সাজঘরে ফিরেছেন তামিম ইকবাল (১২), ইমরুল কায়েস (১৫), সাকিব আল হাসান (২), সাব্বির রহমান (২৪), মুমিনুল হক (২৯) ও তাইজুল ইসলাম (৪)। মূলত তামিম ও সৌম্যের (৯) টানা দুই ইনিংসেই ব্যর্থতা বাকি ব্যাটসম্যানদের হতচকিত করে দেয়। অবশ্য পেসার প্যাট কামিন্সই প্রথম ধাক্কা দিয়েছিলেন সৌম্যকে ফিরিয়ে। প্রাথমিক বিপর্যয়ের সেই সুযোগে স্টিভ ও’কিফে ও লিয়নের স্পিন মারাত্মক হয়ে ওঠে। যেই ঘূর্ণি জালে ফেঁসে মাত্র ১৫৭ রানেই দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয়ে যায় টাইগারদের। যদিও ডানহাতির স্পিন ফাঁদ এড়াতে নাসির হোসেনকে চার নম্বরে নামানো হয়েছিল ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন ঘটিয়ে। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি দলে নিজের অবস্থান নিয়ে দোলাচলে থাকা নাসির মাত্র ৫ রানেই সাজঘরে ফিরে। ৪৩ রানেই ৫ উইকেট হারানোর পর শঙ্কা জমেছিল ইনিংস পরাজয়ের লজ্জা বরণের। সেই লজ্জা কাটিয়ে দলকে লিড এনে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ইনিংসের দুই সেরা পারফর্মার মুশফিক ও সাব্বিরের ষষ্ঠ উইকেটে ৫৪ রানের জুটি বড় অবদান রাখে। দারুণ খেলতে থাকা এ দুই ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরার পর দারুণ ধৈর্য দেখিয়েছিলেন ৮ নম্বরে নামা মুমিনুল। তবে লিড বড় হয়নি। মাত্র ৮৫ রানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। চতুর্থদিনে আধাঘণ্টা আগে খেলা শুরু হয়েছিল আগেরদিন বৃষ্টিতে আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় নষ্ট হওয়াটাকে পুষিয়ে নিতে। সে কারণে অসিদের দিনে আর ২৩ ওভার খেলার সুযোগ ছিল। ৮৬ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে জেতার জন্য মরিয়া অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই চড়াও হন। কিন্তু মুস্তাফিজ প্রথম আঘাত হানেন টানা দ্বিতীয় ইনিংসে ভয়ঙ্কর ডেভিড ওয়ার্নারকে (৮) শিকার করে। এরপর সাকিব ও তাইজুল একটি করে উইকেট পেলেও দ্রুত রান করা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি অসিদের। বিশেষ করে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ১৭ বলে ২ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ২৫ রানের ইনিংস খেলে মাত্র ১৫.৩ ওভারেই জয় পাইয়ে দেন দলকে। ৭ উইকেটে হারের কারণে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১-১ সমতায় শেষ করতে পেরে সন্তুষ্টি জানান অসি অধিনায়ক স্মিথ। তবে সিরিজ ড্র’কেই অনেক বড় প্রাপ্তি মনে করছেন মুশফিক, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জিতবÑ মনে হয় না, আমরা খেলোয়াড় ও টিম ম্যানেজমেন্ট ছাড়া আর খুব বেশি কেউ বিশ্বাস করেছিল। প্রাপ্তি অনেক বড়। আর আমাদের জন্য এটা খুব একটা সহজ ছিল না। দেশের মাটিতে আমরা ৮/৯ মাস পর টেস্ট খেলেছি। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে জিতেছি এটা তো অবশ্যই অনেক বড় প্রাপ্তি। আরও ভাল করার সুযোগ ছিল দ্বিতীয় ম্যাচে, সেটা আমরা হারিয়েছি দ্বিতীয় ইনিংসের কারণে। তবে সবমিলিয়ে অনেক ভাল একটা সিরিজ গেছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটা সিরিজ ড্র করা অনেক বড় অর্জন।’ কারণ, এরআগে দুই সিরিজেই ২-০ ব্যবধানে অসিদের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল বাংলাদেশ দল। এবার অবিস্মরণীয় এক অর্জন এনেছেন টাইগাররা।
×