ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা নিধন ॥ মানবতা উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা নিধন ॥ মানবতা উপেক্ষিত

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন অব্যাহত রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের এ দেশে অনুপ্রবেশের ঢলও থামছে না। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্ট দিয়ে প্রাণ নিয়ে কেউ অক্ষত অবস্থায়, কেউ গুলিবিদ্ধ, হাত-পাবিহীন অর্ধমৃত রোহিঙ্গা নারী- পুরুষ ও শিশুর যে ঢল নেমেছে তা বিশ্বজুড়ে এখন আর কারও অজানা নয়। বিশ্ব গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হয়েছে। কিন্তু শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি অনড় অবস্থানেই রয়েছেন। তার পরিকল্পনা ও প্রণীত নীলনক্সায় সে দেশের সামরিক জান্তা বাহিনীর নেতৃত্বে রাখাইন রাজ্যের শহর এলাকা ছাড়াও প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার আনাচে-কানাচে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নিধনযজ্ঞ ক্রমাগতভাবে হিংস্র থেকে হিংস্রতর রূপ নিয়েছে। ফলে সুচির বিরুদ্ধে বিশ্বের দেশে দেশে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। শান্তিতে পাওয়া তার নোবেল কেড়ে নেয়ার দাবিও উঠেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, মংডু, বুচিদং, রাচিদং শহরগুলোর বিভিন্ন এলাকায় এখনও প্রায় তিন লক্ষাধিক নারী ও শিশুকে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে সারাবিশ্বের কাছে প্রমাণ করার উদ্দেশ্য। বিষয়টি অভিনব ও বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য। এছাড়া মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) বৈঠক শেষে বুধবার রাতে বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের কোন প্রমাণ বা কাগজপত্র না থাকলে কোন রোহিঙ্গাকে সে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে না বলে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে সকল খবর সবৈব মিথ্যা বলে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাজুড়ে সে দেশের সেনাবাহিনীর উদ্যোগে স্থলমাইন পোঁতা অব্যাহত রয়েছে। স্থলমাইন পোঁতার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবাদ জানানো হলেও তা বন্ধ করার কোন লক্ষণ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেখা যায়নি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার টেকনাফের নাফ নদী থেকে শিশুসহ ১১ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এসব মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায়। এদিকে, বুধবার রাতে সীমান্ত এলাকায় সে দেশের বিজিপি সদস্যরা আবারও পলায়নরত রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমেনি এরদোগান এবং সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। রোহিঙ্গাদের এ দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখে তিনি বিস্মিত হন এবং তার সফরসঙ্গীদের কাছে এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী বলে উল্লেখ করেন। অপরদিকে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার মানবিক আচরণের পথ বেছে নেয়ায় পুরো সীমান্ত এলাকা এখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য প্রকারান্তরে উন্মুক্তই হয়ে গেছে। কখনও কখনও যাদের পুশব্যাক করা হচ্ছে তারা আবারও ভিন্ন পথে পুশইন হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্বের নানা দেশের প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে এনএলডি নেত্রী নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচি গত বুধবার নতুন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা শতাব্দীর সেরা মিথ্যাচার হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দফতর থেকে সুচিকে উদ্ধৃত করে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভুয়া খবর এবং মিথ্যা প্রচার চলছে। প্রচারের বিষয়টিকে উস্কানি বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। এর আগে তিনি বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসীরা বাঙালী এবং জঙ্গী। তাদের দমনে সেনা অভিযান চলছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, রাখাইন রাজ্য থেকে সমূলে রোহিঙ্গাদের নিধন ও উৎখাত অভিযান। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আড়াই লাখে ছুঁই ছুঁই করছে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ, আহত, হাত-পাবিহীন রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুদের আহাজারিতে কক্সবাজার অঞ্চলে হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে আছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা যারা এখনও চিকিৎসা কার্যক্রমের বাইরে থেকে খোলা আকাশের নিচেই মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় রয়েছে। আর যারা প্রাণ নিয়ে এপারে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে তাদের অবস্থাও শোচনীয়। বিশেষ করে খাদ্য ও পানীয় সঙ্কট তীব্র। টেকনাফ থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি স্থানসমূহের পাহাড় ও ঝোপ জঙ্গলে এদের কেউ কেউ ত্রিপল টাঙিয়ে কেউ বা খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছে। পরিবারের কোন না কোন সদস্য প্রাণ হারিয়েছে বা নিখোঁজ রয়েছে এদের মধ্যে এমন কেউ নেই। অপরদিকে, বুধবার রাতে সীমান্ত এলাকায় আবারও নির্বিচারে মিয়ানমার বাহিনী গুলিবর্ষণ করেছে। এতে প্রাণহানিও ঘটেছে। আহতের সংখ্যা বহু বলে সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানানো হয়েছে। সর্বশেষ ॥ রাখাইন রাজ্যে সেনা নেতৃত্বে চলমান কিলিং অপারেশন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের পথে রোহিঙ্গা বহরে বুধবার রাতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। এতে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। এর মধ্যে ৫ রোহিঙ্গার মৃতদেহ স্থানীয়রা উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও বিজিপির কড়া পাহারার কারণে বাকি লাশগুলো এ পারে আনা সম্ভব হয়নি। বুধবার বিকেলে উখিয়ার পালংখালী সীমান্ত বরাবর মিয়ানমারে কুয়ানচিবং ও রাইম্মনখালীর মধ্যবর্তী গদুরা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সূত্র জানিয়েছে, বুচিদংয়ের তংবাজার থেকে একদল রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে আসার সময় বিজিপি সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। এ সময় রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করলে তাদের ওপর শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ফলে অসংখ্য রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। রক্তে রঞ্জিত হয় রাস্তাঘাট। আরও ১১ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার ॥ টেকনাফের নাফ নদী থেকে বৃহস্পতিবার সকালে শিশুসহ ১১ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগের দিন বুধবার ৬ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার নাফ নদীতে মরদেহ ভাসতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় এসব মরদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৪ শিশু, ১ নারী এবং ৬ পুরুষ রয়েছেন। সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানিয়েছেন, শাহ পরীর দ্বীপের মাঝেরপাড়ায় ৩ শিশু ও ২ নারীর লাশ উদ্ধার হয়েছে। ফলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৩ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহেদ হোসেন সিদ্দিক। এদিকে, রোহিঙ্গা গণহত্যায় বিশ্ব সম্প্রদায় বিলম্বে সোচ্চার হলেও মিয়ানমার প্রশাসন তা তোয়াক্কা না করে রোহিঙ্গা কিলিং অপারেশন অব্যাহত রেখেছে। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এমন কোন দিন নেই, যেদিন রোহিঙ্গা হত্যাকা- চালায়নি সেনা নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গত ১৩ দিনে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এছাড়া ৩ লাখের বেশি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে বলে ওপারের বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। সুচি সরকারের নয়া কৌশল ॥ মংডুর যেসব অঞ্চলের রোহিঙ্গা পল্লীতে এখনও সেনাবাহিনীর তা-ব চলেনি সেসব গ্রাম বা এলাকার গণ্যমান্য রোহিঙ্গা ব্যক্তিদের ডেকে বিশেষ আদেশ দিয়েছে সেনা সদস্যরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রশাসনের কথামতো একটি বিশেষ সভায় রোহিঙ্গারা উপস্থিত হলে তাদের বলা হয়, ‘আমরা তোমাদের মারব না, কাটব না, তোমাদের ঘরে আগুনও দেব না। তোমরা আগের মতো এখানে বসবাস করতে পারবে। তবে একটি শর্ত পালন করতে হবে। তোমাদের নিজেদের বসতঘরে তোমরা আগুন লাগিয়ে দিয়ে তা ভিডিও করে আমাদের দেবে। কেউ এ সিদ্ধান্ত না মানলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। এদিকে, সেনা সদস্যদের তরফ থেকে এমন হুমকি পেয়ে এখনও সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা আরও বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় পড়েছে। আবার অনেকে বাংলাদেশ অভিমুখী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সোচ্চার হওয়ায় কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে সুচি সরকার। এ চাপ মুক্ত হতে বরাবরের মতোই মিথ্যাচারের পথ বেছে নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গারা নিজেদের ঘর নিজেরা পুড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছে বলে আন্তর্জাতিক মহলকে বুঝানোর লক্ষ্যেই জিম্মি হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এ আদেশ দিয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মংডু টাউনশিপের পাবলিক হল মিলনায়তনে নুরুল্লাপাড়া, পেরামপ্রু, মগ্নিপাড়া, খায়রপাড়া. উকিলপাড়া, রইগ্যাদং, কাহারিপাড়া ও সিকদারপাড়ার রোহিঙ্গা সর্দার মাতব্বরদের ডেকে সেনা ও নাসাকা বাহিনীর কর্মকর্তারা এ নির্দেশনা দিয়েছে বলে সেখানকার সূত্রগুলো খবর দিয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার সকালেও উত্তর মংডুর সীমান্তবর্তী গ্রাম ঢেঁকিবুনিয়ায় আরও বেশকিছু রোহিঙ্গা বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে সেনারা। উলুবনিয়ায় গুলি ॥ টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তাদের ছোড়া কিছু তাজা বুলেট নাফ নদী পেরিয়ে এপারের উলুবনিয়া গ্রামে এসে পড়েছে। এতে সীমান্ত এলাকার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এলাকার ইউপি সদস্য হাজী জালাল আহমদ জানান, ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা যায়। পরবর্তীতে জানা গেছে, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। মিয়ানমার বাহিনীর ছোড়া বুলেট সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা ॥ উখিয়া-টেকনাফের উনছিপ্রাং রইক্ষ্যং পুটিবনিয়া, থাইংখালী, বালুখালী ও কুতুপালংয়ের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তারা যত্রতত্র খোলামেলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগের কারণে দুর্গন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবায় বিজিবি ও কিছু এনজিও কাজ করছে। বিজিবির মেডিক্যাল টিমের প্রধান টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের মেডিক্যাল অফিসার মেজর ডাঃ মোঃ আলম জানান, ক্যাম্পে জ্বর, ঠা-া, সর্দি ও ডায়রিয়ার রোগী বেশি। গত তিন দিনে বিজিবির মেডিক্যাল টিম প্রায় দেড় হাজার রোগীকে ফ্রি চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে। কক্সবাজার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিক্যাল টিমের সমন্বয়ক ডাঃ মনজুরুল কাদের আহমদ জানান, তারা একদিনে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ডাঃ মনজুরুল কাদের আরও জানান, তারা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জখমপ্রাপ্ত রোগী ছাড়াও গুলিবিদ্ধ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। আইওএম-এর ছয়জনের মেডিক্যাল টিম এ অস্থায়ী ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেছে। আইওএম-এর মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ জিনাংশু তংচইংগ্যা, ডাঃ নিরন্ত কুমার দাশ বহু রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা শিবিরে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে ॥ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোগান। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তিনি তুরস্কের একটি বিশেষ বিমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে সড়কপথে প্রথমে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাভাসোগলু, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা তার সঙ্গে ছিলেন। তুরস্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হন এবং সফরসঙ্গীদের কাছে এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। ফার্স্ট লেডির সফর উপলক্ষে কক্সবাজার থেকে উখিয়া পর্যন্ত সড়কপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। ছড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা ॥ কোন বাধানিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। ফলে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গারা যে যেখানে পারে ছড়িয়ে যাচ্ছে। জেলার আনাচে-কানাচে সর্বত্র শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, শুধু উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতেই নয়, কক্সবাজারের সীমানা পার হয়ে রোহিঙ্গারা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া কিছু সচ্ছল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায় বাসা ভাড়া করে অথবা স্বজনদের বাসায় ঠাঁই নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করলেও এ সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। অনুপ্রবেশ অব্যাহত ॥ গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। অনুপ্রবেশের পর প্রথমে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান নেয় তারা। পরে সুযোগ বুঝে কৌশলে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদস্যরা ৫০ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে আটক ও পরে মানবিক দিক চিন্তা করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট স্থানে রাখা জরুরী ॥ উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূর জানিয়েছেন, বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা নেই। এখন অসংখ্য পরিবার বাইরে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছে। আবার অনেকেই বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। শুধু কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প নয়, টেকনাফের নয়াপাড়া ও লেদা ক্যাম্পেও রোহিঙ্গাদের তিলধারণের ঠাঁই নেই। উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের অন্য কোথাও ছড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য আমরা তৎপর। কিন্তু ফাঁক-ফোকর দিয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের চলে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং যাচ্ছেও। রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। সমালোচনার মুখে সুচির নোবেল ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধ না করে উল্টো সেনা অভিযানকে সাধুবাদ জানানোর পর চরম সমালোচনার মুখে পড়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে সুচিকে দেয়া শান্তির নোবেল ফেরত নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। ওআইসির শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক অঙ্গ সংস্থা আইসিসকোর পক্ষ থেকে সুচিকে দেয়া নোবেল প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুচিকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়েই চলেছে। এদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের ফল ভাল হবে না বলে সতর্কবাণী উচ্চারণের পরও সুচি সরকার নিধনযজ্ঞ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সুচির সরকার শক্তিশালী কোন না কোন দেশের সহযোগিতা নিয়ে এ নিধনযজ্ঞে নেমেছে। ফলে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে রাখাইন রাজ্য। শুধু তাই নয়, পালিয়ে আসার পথে রোহিঙ্গারাও প্রাণ হারাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের বুলেট এপারেও এসে পড়ছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আচরণের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে এবং বুধবার পর্যন্ত দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা নর-নারী ও শিশুর সংখ্যা সোয়া লাখেরও বেশি। রোহিঙ্গার ভারে উখিয়া-টেকনাফে বিপর্যয় ॥ বর্তমানে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আশ্রিত হিসেবে রয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, (বালুখালীর ঢালা), থাইংখালী তাজনিমারখোলা পাহাড়, পালংখালী বাঘঘোনা পাহাড়, টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া, মুছুনি, শামলাপুর ও ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত এলাকায়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার অর্থ যোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। কুতুপালং, বালুখালী ছাড়াও উখিয়ার বালুখালীর ঢালা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা ও বাঘঘোনাতে বন বিভাগের জায়গার ওপর সামাজিক বনায়ন কেটে রাতারাতি ৬-৭টি নতুন বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। এসব বস্তিগুতে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা গত কয়েকদিনে আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় সূত্রগুলো। প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকায় কুতুপালং, বালুখালীর ক্যাম্পগুলোয় স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। ফলে ক্যাম্পে ঠাঁই মিলছে না অধিকাংশের। তারা রাস্তাঘাট, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। এককথায় রোহিঙ্গার ভারে জর্জরিত হয়ে আছে উখিয়া-টেকনাফ এলাকার জনমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এছাড়াও কানাপাড়া, মধ্যমপাড়া, পাথরকাটা, রেজুআমতলী, আছার বাগান, জলপাইতলী, কলাবাগান, গর্জনবনিয়া, কেউয়াছড়ি, পাথরাঝিরি, বাইশারী, আজুখাইয়া ও উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া, নলবনিয়া, রহমতেরবিল, ধামানখালী, বালুখালীর ঘাট সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে অনুপ্রবেশ করে সেখানকার পাহাড়ে ঝুপড়িঘর তৈরি করছে। উখিয়ার বালুখালী অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি লালু মাঝি জানিয়েছেন, এ ক্যাম্প এখন কানায় কানায় পূর্ণ। আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের জায়গা দেয়া এখন দুঃসাধ্য। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানিয়েছেন, সীমান্তজুড়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তাদের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে, যাতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সেভাবেই কাজ করছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো কোনমতেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপনের দাবি ॥ কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সদস্য এ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলাসংলগ্ন সীমানার পার্শ¦বর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ অবস্থিত। সম্প্রতি মিয়ানমারের জাতিগত সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান রিপোর্ট মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। বিষয়টি জরুরীভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি ॥ মিয়ানমার সরকারের তথ্য কমিটির জারিকৃত সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গাদের আবারও বাঙালী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শুধু বাঙালী নয়, বলা হয়েছে বাঙালী সন্ত্রাসী। এসব সন্ত্রাসী গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এসব সন্ত্রাসীকে ‘আরসা সন্ত্রাসী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। গত বুধবার মিয়ানমারের একটি ইংরেজী দৈনিকে সুচি সরকারের তথ্য কমিটির বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে মিয়ানমারের উত্তর আরাকানে (রাখাইন এস্টেট) গত ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ দিনের সহিংসতায় ৫৯ গ্রাামের ছয় হাজার ৮৪২ বাড়ি ভস্মীভূত, আটটি ব্রিজ ধ্বংস ও সেনা অভিযানে ৩৯৭ জন ‘আরসা সন্ত্রাসী’ হত্যার দাবি করা হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে ‘আরসা সন্ত্রাসী’দের সঙ্গে ৯৭টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও ঘটেছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রায় ২৭ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ না থাকলে ফেরত নেয়া হবে না ॥ মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) কমিটি বুধবার রাতে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না থাকলে কাউকে সে দেশে ফেরত নেয়া হবে না। উপদেষ্টা ইউ থাং টুন-এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে বলা হচ্ছে তাদের কাছে নাগরিকত্বের বা এ সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র পাওয়া না গেলে ফেরত নেয়া হবে না। মিয়ানমারে বহু বছর ধরে বসবাস করছেন এমন প্রমাণ যাদের কাছে পাওয়া যাবে তারা ফিরতে পারবেন। বুধবার রাতে এনএসএ’র বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। উপদেষ্টা টুন আরও বলেছেন, নাগরিকত্বের কাগজপত্র থাকলে তাদের নিরাপত্তায় কোন বিঘœ ঘটবে না। সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
×