ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান ॥ নড়াইলে চার দিনব্যাপী উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান ॥ নড়াইলে চার দিনব্যাপী উৎসব

সাজেদ রহমান/রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল থেকে ॥ শিশু, বৃক্ষ, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুর প্রতিই তার অফুরন্ত ভালবাসা। শুধু রংতুলির স্পর্শে এর মধ্যে তিনি সৌন্দর্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাথ থেকে দুর্লভ নাগালঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্লাবিত হয়েছিল। বলতেন, এ তো একটি বৃক্ষের নিঃশেষ নয়, গোটা জীবনের পরিসমাপ্তি। সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তিনি ব্যয় করেন শিশুদের কল্যাণে নির্দ্বিধায়। সেই মহান মানুষটি হলেন শিল্পী এসএম সুলতান। গত ১০ আগস্ট ছিল বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৩তম জন্মজয়ন্তী। কিন্তু ঈদের কারণে এবার অনুষ্ঠান পিছিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর করা হয়। এ উপলক্ষে গত বুধবার থেকে নড়াইলে চার দিনব্যাপী সুলতান উৎসব শুরু হয়েছে। ‘সংস্কৃতির চর্চাই হোক আমাদের সুন্দর আগামীর প্রেরণা’- এ সেøাগানকে সামনে রেখে নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের সুলতান মঞ্চ চত্বরে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছবি এঁকে উৎসবের উদ্বোধন করেন নড়াইল জেলা প্রশাসক মোঃ এমদাদুল হক চৌধুরী। এরপর পর্যায়ক্রমে আর্ট ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম এবং চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন নড়াইল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেন বিশ্বাস। এই কয়দিনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেনÑ এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রফেসর অশোক কুমার শীল, রানার অটোমোবাইলস লিমিটেডের পরিচালক মোঃ জহুরুল আলম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গভঃ কলেজ আর্টস এ্যান্ড ক্রাফটের অধ্যাপক সুমন পাল, পশ্চিমবঙ্গের চিত্রশিল্পী স্বপন কুমার রায়, এসএম সুলতান ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মিকু, এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেখ হানিফ প্রমুখ। উদ্বোধনী সভা শেষে শিল্পী সুলতানের পালিত কন্যা নিহারবালাকে শুভেচ্ছা উপহার তুলে দেয়া হয়। এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে চার দিনব্যাপী এ উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় রয়েছেÑ আর্ট ক্যাম্প, চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিল্পী এসএম সুলতানের জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা সভা ও নড়াইল জেলার আটটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ভারতের অতিথি শিল্পীদের সঙ্গীত, নৃত্যসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বৃহস্পতিবার বিকেলে সুলতানের কর্মজীবনের ওপর আলোচনা এবং রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উৎসব প্রাঙ্গণে শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শতাধিক দোকানি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষের জন্য কসমেটিকস, হস্তশিল্প, কুঠিরশিল্পসহ নানান ধরনের পণ্য রয়েছে এসব দোকানে। এদিকে সুলতানের ৯৩তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও সুলতান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ৯ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকেল ৩টায় চিত্রা নদীতে অনুষ্ঠিত হবে আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। এসএম সুলতান ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব মোঃ আশিকুর রহমান মিকু জানান, প্রতিযোগিতায় এ বছর নড়াইল, খুলনাসহ পার্শ্ববর্তী জেলার ২২টি নৌকা অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এর মধ্যে নারীদের পাঁচটি এবং পুুরুষদের ১৭টি নৌকা রয়েছে। নৌকার মালিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এদিকে উৎসব ও নৌকাবাইচকে ঘিরে নড়াইলবাসীর মাঝেও উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পী জন্মেছিলেন সবুজ স্নিগ্ধতায় ছাওয়া নড়াইলের উপকণ্ঠে ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট। পিতা ছিলেন সামান্য রাজমিস্ত্রী। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের আবহ তাই শিল্পী পেয়েছিলেন শৈশবেই। স্কুলে পড়ার সময় ড. শ্যামা প্রসাদের বক্তৃতাদানরত ছবি এঁকে প্রশংসা পেয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান। ৪১-এ ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ৪শ’ প্রতিযোগীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় অঙ্কনে প্রথম স্থান অধিকার করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাধাধরা গ-ি তার কাছে ছিল আকর্ষণহীন। ৪৩-এ সেখান থেকে পলায়ন। সারা ভারত পরিভ্রমণ। আর এ সময় অজস্র ছবি আঁকার কাজও চলে। ৪৪-এ সিমলায় একক চিত্র প্রদর্শনী। দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনীও এখানে ৪৬ সালে। লাহোর ও করাচীতে একক চিত্র প্রদর্শনী ৪৭ ও ৪৮ এবং ৪৯-এ। করাচীতে ‘ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন’ আয়োজিত (৪৯) ৪৫টি দেশের শিল্পীরা চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এর মধ্যে শিল্পী সুলতানের ছবি শ্রেষ্ঠ হিসেবে পুরস্কৃত হয়। কিন্তু একদিন সেখানে ৪শ’ ছবি রেখে আবার পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়া। ১৯৫০ সালে লন্ডন গমন। সেখানে চারটি একক চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এশিয়ার একমাত্র ‘কনটেস্পোয়্যারি মাস্টার’ উপাধিতে ভূষিত আর্ট গ্যালারি এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক। পরের বছর নিউইয়ার্ক এ পাবলো পিকাসো, সালভ্যাদও দালি র‌্যাবেথ ক্লি প্রমুখ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর চিত্রকর্মের সঙ্গে সুলতানের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। দেশে আসেন ১৯৫৩ সালে। নড়াইলে পরের বছর নন্দনকানন আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা। ১৯৬৯-এ প্রতিষ্ঠা চারুকলা ইনস্টিটিউটের। যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্টস প্রতিষ্ঠা ১৯৭৩ সালে, বর্তমানে যা চারুপীঠ। বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পী সুলতানের একক চিত্র প্রদর্শনী। ১৯৮১ সালে শিল্পকলা একাডেমির আবাসিক আর্টিস্ট হিসেবে মনোনয়ন। ঢাকায় দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী ১৯৮২ সালে। ওই বছরই নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ’র উদ্বোধন। ১৯৮৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার ওই বছরের বিশ্বের সেরা কৃতী মানব হিসেবে আখ্যা দেয় তাকে। ঢাকার জার্মান কালচারাল ইনস্টিটিউটে তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৮ সালে তিনি পান একুশে পদক। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় আর্ট খ্যাতনামা শিল্পীদের পাশাপাশি সুলতানের চিত্রকর্মও প্রদর্শিত হয়। চিরকুমার শিল্পী ছবি এঁকেছেন দু’হাতে। ব্যবহার করেছেন দেশজও লতাপাতা ও শিকড়ের নির্যাস থেকে সংগৃহীত রং। মোট ছবির সংখ্যা তিনি নিজেও জানতেন না। তবে লক্ষাধিক হবে, যা তিনি কখনও সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব করেননি। যাকে খুশি তাকে দিয়েছেন অকাতরে। তার অনন্য সৃষ্টির মধ্যে আছেÑ ‘চরদখল’, ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’, ‘মাড়াই’, ‘গ্রামের দুপুর’, ‘দেশপ্রেম’, ‘আটপায়ে একজন’, ‘মাছ ধরা’, ‘বনভূমি ও স্বাধীনতা’, ‘বিপ্লব’ প্রভৃতি। উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বহু ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। তার ছবিতে গাঁয়ের কৃষকও পেশীবহুল। আদিম সাম্যবাদী সমাজে একজন কৃষক যেমন পুষ্টিহীনতার সঙ্গে পরিচিত ছিল না। শিল্পী সুলতানও মনে করেন, দুঃখ-দারিদ্র্য এসব সমাজের কৃত্রিম সৃষ্টি। ব্যক্তিগত খ্যাতি, আর্থিক প্রতিপত্তি এসবের প্রতি সুলতানের কোন মোহ ছিল না। সব ধর্মের মানুষই তার কাছে একজন মানবসন্তান। দেশজ প্রেক্ষিত তার ছবির উপজীব্য। নড়াইলে তার শিশুস্বর্গ, যেখানে বাস করতেন, সেখানে বৃক্ষ এবং দুর্লভ ফুলে ভরা ছিল। ছিল বহু পাখি ও জীবজন্তু। তাদের নিজ হাতে তিনি সেবা করতেন। শিল্পী সুলতান ছিলেন প্রচারবিমুখ। চিরকাল তিনি থেকে গেছেন অনগ্রসর, অশিক্ষিত, বঞ্চিত মানুষের মধ্যে। যে শ্রেণী থেকে তার উত্থান ঘটেছিল, সেই তাদেরই বেছে নিয়েছেন নিজ সৃষ্টিকর্মের উপজীব্য হিসেবে। পাদপ্রদীপের আলোর সামনে তিনি আসেননি রবং তিনি নিজেই ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, মানুষকে ভালবাসা, শিশুদের প্রতি ভালবাসা, বৃক্ষ এবং পশুদের প্রতি মমত্ববোধ- এসবের ভেতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন নিজের পৃথক সত্তা ও অবস্থানটির কথা। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে শায়িত করা হয়। কিন্তু তার এ বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় জীবন এবং কর্মযজ্ঞ এখন পর্যন্ত কোন পাঠ্যপুস্তক বা শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শেখ হানিফ বলেন, তার (সুলতান) কর্মময় জীবন ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পাঠ্যপুস্তকে আসা প্রয়োজন। মাটি ও মানুষের এ শিল্পীর ছবি পাঠ্যপুস্তকে এলে তার জীবন ও দর্শন আরও ব্যাপ্তিময় হবে।
×