ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে বেহাল মুশফিকরা, লিয়নের ঘূর্ণিতেই সব ল-ভ-, অস্ট্রেলিয়া জিতল ৭ উইকেটে, দুই টেস্টের সিরিজ ১-১ ড্র

ব্যাটিং ব্যর্থতায় আশার সমাধি সাগরিকায়

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ব্যাটিং ব্যর্থতায় আশার সমাধি সাগরিকায়

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ স্বপ্ন, খুব ছোট্ট একটি শব্দ। যখন একটি বড় স্বপ্ন পূরণের মোক্ষম সুযোগ চলে আসে, কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যায় ভেঙ্গে যায় হৃদয়, মন। তবে হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদ নেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের, নেই দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরও। তবে আক্ষেপ আছে সুযোগ ফসকে যাওয়ায়। স্বপ্ন ছিল বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যবাহী টেস্ট খেলুড়ে দল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের। কিন্তু ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণে চট্টগ্রামে হওয়া দ্বিতীয় টেস্টে চারদিনেই ৭ উইকেটে অসিদের কাছে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এই স্বপ্নভঙ্গের মূল খলনায়ক ডানহাতি অফস্পিনার নাথান লিয়ন। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট শিকার করা এ বোলার দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। ফলে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শেষ হয়েছে ১-১ সমতায়। মিরপুরে হওয়া প্রথম টেস্টে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয় পায় টাইগাররা ২০ রানে। সিরিজ জয়ের ইতিহাস হাতছানি দিলেও ধরা দেয়নি, তবে ড্র করেই অন্যরকম এক গৌরব দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। ১০২ টেস্টে সপ্তমবারের মতো সিরিজ ড্র করতে সক্ষম হলো বাংলাদেশ দল। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল। এবারের সিরিজ ড্র তাই দারুণ গৌরবময় অর্জন বাংলাদেশের। আগেরদিনের ৯ উইকেটে ৩৭৭ রান করা অস্ট্রেলিয়ার ৭২ রানে এগিয়ে যাওয়াটাই চোখ রাঙ্গাচ্ছিল। কারণ উইকেটে তৃতীয়দিনের শেষবার বোলারদের বেশ সুবিধা দিতে শুরু করে। বিশেষ করে বাংলাদেশী স্পিনাররা ভয়ানক হয়ে ওঠেন। চতুর্থদিনের আগেই তাই দুরুদুরু বুক বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের- চতুর্থদিনে হয়তো একটি উইকেট অসিদের দ্রুতই তুলে নেয়া যাবে, কিন্তু বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা কোন অগ্নিপরীক্ষায় পড়বেন সেটা নিয়েই যত শঙ্কা। এই শঙ্কাগুলোই বাস্তব হয়েছে। আগেরদিন বৃষ্টির কারণে আড়াই ঘণ্টার বেশি খেলা নষ্ট হয়েছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাই চতুর্থদিন আধাঘণ্টা আগেই সাগরিকার উইকেটে ক্রিকেটীয় লড়াই শুরু হয়। চতুর্থদিনে বাংলাদেশের লড়াই দেখতে গত কয়েকদিনের তুলনায় কিছুটা বেশিই দর্শক এসেছিলেন। শুরুতেই তাদের আনন্দে ভাসার সুযোগ করে দেন দুরন্ত হয়ে ওঠা বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। দিনের প্রথম ওভার সাকিব আল হাসান মেডেন দিয়ে শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় ওভারে আক্রমণে এসেই মুস্তাফিজ শিকার করেন নাথান লিয়নের উইকেট। আর কোন রান যোগ হয়নি, ৩৭৭ রানেই গুটিয়ে যায় অসিরা প্রথম ইনিংসে মাত্র ৮ মিনিট ও ১১ বল ব্যাট করে। যথারীতি শুরুটা করেছিলেন তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। লোকাল হিরো তামিম মিরপুর টেস্টে উভয় ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলের জয়ে রেখেছিলেন দারুণ ভূমিকা। কিন্তু নিজের ঘরের মাটিতে খেলা টেস্টের পরিসংখ্যান বরাবরই তেমন সুখকর নয় তার ক্যারিয়ার খতিয়ান বিবেচনায়। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৯ রানে তিনি বিদায় নেয়ার কারণেই খুব বড় সংগ্রহ হয়নি বাংলাদেশের (৩০৫)। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭২ রানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ আস্থা নিয়ে তার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেননি এবারও। ফিরে যান মাত্র ১২ রানে। অবশ্য এর আগেই চিরাচরিতভাবে ব্যর্থ সৌম্য এবারও হতাশ করেছেন মাত্র ৯ রানে আউট হয়ে। আগেরদিন পেসার মুস্তাফিজ নতুন বলে ঝলসে উঠেছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই অসি গতিরাজ প্যাট কামিন্স দুর্ধর্ষ কিছু করবেন সেটা অনুমিতই ছিল। ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই প্রথম আঘাত হেনে সেটা প্রমাণ করলেন তিনি। তবে লিয়ন অপরপ্রান্তে আগের মতোই বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন ঘূর্ণি বলে। আর কামিন্সকে সুযোগ দেননি তিনি। একের পর এক শিকার তুলে নিতে শুরু করেন লিয়ন। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে তার ডানহাতি অফস্পিন প্রথম ইনিংসেও দারুণ কার্যকর হয়েছিল। এবারও তিনিই মূল হন্তারক হয়ে ওঠেন। টানা ব্যর্থতার জালে বন্দী ইমরুল কায়েস সে কারণেই ভড়কে গেলেন আরেকবার। এবার সিরিজে নিজের সর্বোচ্চ ১৫ রান করে সাজঘরে ফেরেন লিয়নের দ্বিতীয় শিকার হয়ে। মাত্র দুই ওভার পরেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবকে ফেরান তিনি। প্রথম ইনিংসে ২৪ রান করা সাকিব এবার আরও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন ২ রানে। লিয়নের সাফল্যে অপরপ্রান্তেও স্পিন আক্রমণ নিয়ে আসে অসিরা, মোতায়েন করা হয় স্টিভ ও’কিফেকে। আর মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম দুই নায়ক তামিম ও সাকিব সাজঘরে ফেরার পরই আরও আক্রমণাত্মক, ফুরফুরে ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে অসিরা। অপরদিকে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা হয়ে পড়ে কোণঠাসা। এবার অবশ্য ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন এনে চার নম্বরে নামানো হয় ডানহাতি নাসির হোসেনকে। প্রথম ইনিংসে টানা ৪ বাঁহাতি টপঅর্ডারকে শিকার করেছিলেন লিয়ন, সে কারণেই এ পরিবর্তন। দীর্ঘদিন টেস্ট ফরমেটে এবং অন্য ফরমেটগুলোতে অধরাবাহিক এ অলরাউন্ডার এ সিরিজে দলে ফিরেছিলেন। এবার চার নম্বরে নেমে দারুণ সুযোগ ছিল নিজেকে মেলে ধরে প্রমাণ করার পাশাপাশি দলের জন্য অবদান রাখার। নাসির সেই আস্থার মূল্য দিতে পারেননি। তিনি ৫ রান করে ও’কিফের ঘূর্ণিতে সাজঘরে ফেরেন। দলীয় মাত্র ৪৩ রানে ৫ উইকেট হারানো যার সবগুলোই টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান। মাত্র ৭২ রানে এগিয়ে থাকা অসিদের চোখেমুখে তখন জ্বলজ্বলে স্বপ্ন ইনিংস জয়ের, শঙ্কাটা বাংলাদেশ শিবিরেও দানা বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে দারুণ এক প্রতিরোধ গড়েন সাব্বির রহমান। প্রথম ইনিংসে সফল এ দুই ব্যাটসম্যান বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে বিপদ কাটিয়ে ওঠার পথে নিয়ে যেতে থাকেন বাংলাদেশ দলকে। ইনিংস পরাজয়ের যে শঙ্কার মেঘ জমতে শুরু করেছিল তারা ৫৪ রানের জুটি গড়ে উল্টো বাংলাদেশকে লিড এনে দেন। আর সেই সময়ই প্রথম ইনিংসের ভুলটাই দ্বিতীয়বার করলেন সাব্বির। লিয়নের বলেই স্টাম্পিংয়ের শিকার হন ২৪ রান করে। ৮ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে আসেন মুমিনুল হক। দারুণ ধৈর্য ও সাবলীলতার পরিচয়ও দিতে থাকেন। মুশফিকের সঙ্গে তার আরেকটি জুটি কেবল জমতে শুরু করেছিল সেই সময় আঘাত হানেন ফিরতি স্পেলে আসা কামিন্স- ৩১ রান করা মুশফিককে ফিরিয়ে দেন সাজঘরে। ১০৩ বলের কঠোর অধ্যবসায়ী ইনিংসের যবনিকা ঘটে যা আর কোন ব্যাটসম্যান পেরোতে পারেননি। মুমিনুল চেষ্টা করেছেন উইকেটে টিকে থেকে লিড বাড়িয়ে নেয়ার। তাকে ধৈর্যের সঙ্গে ভালই সঙ্গ দিচ্ছিলেন মিরাজ। কিন্তু মুমিনুল ফিরে যান আগেই, লিয়নের পঞ্চম শিকারে পরিণত হন ৬১ বলে ২৯ রান করার পর। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় এরপরই। আর ৮ রান যোগ করতেই ১৫৭ রানে দ্বিতীয় ইনিংস গুটিয়ে যায় টাইগারদের। ৬ উইকেট নেন লিয়ন। এটি টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ দলের চতুর্থ সর্বনিম্নœ সংগ্রহ। মাত্র ৮৬ রানের জয়ের লক্ষ্য। শুরু থেকেই তাই ভীষণ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে অসিরা। কারণ দিনের খেলা বাকি ছিল মাত্র ২৩ ওভার। কিন্তু পঞ্চম ওভারেই আবার আঘাত মুস্তাফিজের। ভয়ঙ্কর ডেভিড ওয়ার্নারকে (৮) টানা দ্বিতীয় ইনিংসে শিকার করেন উইকেটরক্ষক মুশফিকের গ্লাভসে বন্দী করে। শুরুর এই ধাক্কা খুব বেশি সুফল বয়ে আনতে পারেনি। অসি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ উইকেটে এসে ঝড় তোলেন, তবে মাত্র ৯ বলে ৩ চারে ১৬ রান করার পর তাকে থামান তাইজুল ইসলাম। পরের ওভারেই ম্যাট রেনশকে (২২) তুলে নিয়ে ম্যাচে প্রাণ ফেরান সাকিব। কিন্তু হ্যান্ডসকম্ব ১৪ বলে ১৬ আর বিধ্বংসী গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ১৭ বলে ২ চার ও ২ ছক্কায় ২৫ রান করে অপরাজিত থেকে দলের জয় নিশ্চিত করেন। মাত্র ১৫.৩ ওভারেই ৭ উইকেটের দারুণ জয় তুলে নেয় অসিরা। এ জয়টি অতীব জরুরী ছিল সফরকারীদের। কারণ প্রথমবার সিরিজ হারের শঙ্কায় পড়েছিল তারা। আর মিরপুর টেস্ট জেতার আগেই বাংলাদেশ দল প্রায় ঘোষণাই দিয়েছিল ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতার। সে লক্ষ্য অর্জনের পথে অনেকখানিই এগিয়ে গিয়েছিল টাইগাররা প্রথম টেস্টে ২০ রানের ঐতিহাসিক জয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাগরিকায় হারতে হয়েছে ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ে চরম ব্যর্থতায়। স্পিনে ঘায়েল অসিরা স্পিন দিয়েই কুপোকাত করেছে স্বাগতিকদের। তবে সিরিজ ড্রয়েও আছে গৌরবময় এক প্রাপ্তি। এর আগে জিম্বাবুইয়ে (১-১, ২০১৩), নিউজিল্যান্ড (০-০, ২০১৩), ভারত (০-০, ২০১৫), দক্ষিণ আফ্রিকা (০-০, ২০১৫), ইংল্যান্ড (১-১, ২০১৬) এবং শ্রীলঙ্কার (১-১, ২০১৭) বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ ড্রয়ের গৌরব দেখিয়েছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুই সিরিজের ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা বরণ করতে হয়েছিল। এবার সেই অসিদের দর্প চূর্ণ করেছে বাংলাদেশ দল আরেকটি সিরিজ ড্র করে। তবে স্বপ্ন ছিল সিরিজ জয়ের। সেটা দেখার যথেষ্ট কারণও ছিল। এর আগে তিনবার সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সিরিজটাই জিতেছিল বাংলাদেশ দল। ২০০৫ ও ২০১৪ সালে জিম্বাবুইয়ে এবং ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই কীর্তি দেখিয়েছিল টাইগাররা। এবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই তিনটি ঘটনার পুনরাবৃত্তির মোক্ষম সুযোগ মিরপুরে প্রথম টেস্ট জয়ের পর। কিন্তু সেটার ব্যতিক্রম ঘটল এবার। তবে অন্তত জয়ের আত্মতৃপ্তি নিয়ে যেতে পারছে না অসিরা। এখানেই সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ দলের।
×