ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের টাকা পাকিস্তানী রুপীর চেয়ে শক্তিশালী

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আমাদের টাকা পাকিস্তানী রুপীর চেয়ে শক্তিশালী

একটা তথ্য দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ম্যাগাজিন ‘ইকোনমিস্ট’-এর গায়ের দাম ঢাকায় ৫৫০ টাকা। এই ম্যাগাজিন ভারতে বিক্রি হয় ৩৫০ ভারতীয় রুপীতে। আর পাকিস্তানে? পাকিস্তানে এর দাম পাকরুপী ৭০০। এই তথ্য কি বলে? আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুদ্রা ‘টাকা’ পাকিস্তানের ‘রুপীর’ তুলনায় বেশি শক্তিশালী। তিন দেশের মধ্যে অবশ্য ভারতীয় ‘রুপী’ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। অথচ ১৯৭১ সালের পূর্বে বর্তমান পাকিস্তানী এবং এ দেশীয় তাদের বশংবদরা বলেছিল স্বাধীন হলে বাংলাদেশকে না খেয়ে মরতে হবে। পাট, চা আর চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ আজ পাকিস্তানের অর্থনীতির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। বর্তমান পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২০ কোটির ওপরে। জনসংখ্যার ভারে দেশটি ভারাক্রান্ত। পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর যারা খবর রাখেন তারাই জানেন এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বড় বিতর্ক বৈদেশিক ঋণ, যা সহ্যসীমা ছাড়িয়েছে। রফতানি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। একইভাবে হ্রাস পাচ্ছে রেমিটেন্স। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাকিস্তান। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত। ধনবৈষম্য মারাত্মক আকারের। বাঁচার জন্য কিছুটা, আর চীনের ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) নীতির কারণে চীনের কাছ থেকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে পাকিস্তান এক দীর্ঘ রাস্তা বানাচ্ছে। এটা ২০-২৫ বছরের প্রকল্প! রাস্তাটি শুরু হয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে। রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর প্রভৃতি শহরের পাশ দিয়ে রাস্তাটি এসে শেষ হবে বেলুচিস্তানের ‘নাদরে’। এটি হবে আধুনিক বড় বন্দর। চীন তৈরি করে দিচ্ছে এই বন্দর। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘সিপেক’Ñ ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর।’ বিশাল অবকাঠামো। সবটাই চীনের ঋণে তৈরি হচ্ছে। চীনা শ্রমিক, চীনা কারিগরি দক্ষ লোকÑ তারাই তা তৈরি করছে। পাকিস্তান সরকারের মতে এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি লাভবান হবে। কিন্তু পাকিস্তানীরা এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট নয়। তারা বলছে পাকিস্তান চীনা ঋণে জর্জরিত হচ্ছে, যা শোধ করার ক্ষমতা পাকিস্তানের থাকবে না। কারণ ‘সিপেক’ অর্থনৈতিকভাবে লাভপ্রদ হবে না। ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ‘জিডিপির’ প্রায় ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আরও ঋণ করা হবে তাদের জন্য বিপজ্জনক। আর এই কাজটিই করা হচ্ছে। এ কারণে পাকিস্তানীরা চীনা ঋণে ‘সিপেক’ অবকাঠামো গড়ে তোলার বিরুদ্ধে। এই যখন পাকিস্তানের অবস্থা, পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা তখন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ ভারতের অর্থনীতির খবর কি? এখানে বৈদেশিক ঋণ অথবা বাজেট ঘাটতি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু গোল বেধেছে অন্যত্র। ২০১৬-১৭ অর্থবছর যা তাদের বেলায় শেষ হয় মার্চ মাসে সে বছরে সাত দশমিক এক শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে হঠাৎ করে ভারতীয় অর্থনীতিতে নেমে এসেছে মঙ্গা। সর্বশেষ এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার নেমে এসেছে দশমকি ৭ শতাংশে! এই নিয়ে চলছে বিতর্ক। এই ধসের কারণ কি? বলা হচ্ছে ‘বিমুদ্রাকরণ’ (ডিমানিটাইজেশন) বর্তমান ধসের জন্য অন্যতম দায়ী। আরেকটি কারণের কথাও বলা হচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে ‘জিএসটি’ (গুডস এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স)। ‘এক দেশ, এক কর’ নীতির প্রতিফলন ‘জিএসটি’, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ব্যবসায়ীরা এই পদ্ধতিটি বোঝে না। বস্ত্রশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত। এর আগে ৫০০ ও ১০০০ রুপীর নোট বাতিলের কারণে সারা ভারতের কোটি কোটি মানুষের কেনা-বেচায় বিঘœ ঘটেছে। ভোগ হ্রাস পেয়েছে। এই দুই কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কারণ। এখন আলোচনায় আসছে অনেক কিছু। মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতি বেশ বেড়েছে। ‘এফডিআই’ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) হ্রাস পেয়েছে। খোদ সরকারের অর্থনৈতিক জরিপই বলছে অনেক কারণের কথা। বিমুদ্রাকরণ, শক্তিশালী রুপী, কৃষকের হ্রাসমান আয়, আইটি শিল্পের আয় হ্রাস, ব্যাংকের খেলাপী ঋণ হ্রাসে কঠোরতর পদক্ষেপ এবং ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণ এখন সামনে আসছে। বলা হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। ‘গ্রোথ’ হচ্ছে, কিন্তু ‘চাকরি’ হচ্ছে না। কৃষিতে উৎপাদন স্থবিরতা চলছে। দ্রব্যমূল্য উর্ধমুখী। সেবা শিল্প ও কৃষি যেখানে কর্মসংস্থান হবে সেখানে কোন নতুন কর্মসংস্থান নেই। এতসব নেতিবাচক তথ্যের মধ্যেই বলা হচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো ঠিক আছে। তবে দরকার নীতিসমূহের পরিবর্তন। জরুরী দরকার ‘আইটি’ খাতের দিকে দৃষ্টিপাত। কয়েক লাখ লোকের চাকরি ইতোমধ্যেই সেখানে গেছে। ১৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই খাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়াকড়ির কারণে এখন পড়েছে সমস্যায়। এতসব সত্ত্বেও ভারতীয় অর্থনীতির ‘ফান্ডামেন্টালস’ যেহেতু ঠিক আছে তাই সাময়িক সমস্যা তারা কাটিয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কার শুরু করেছে। ‘স্বচ্ছ ভারত’ নামীয় প্রবাদমূলক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। নারী শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে। দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচীতে হাত দিয়েছে। গঙ্গা নদীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কর্মসূচী আছে। রাজস্ব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা আছে। ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে আমাদের অর্থনীতিকে কেমন দেখায়? অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে সাধারণ। যেমন রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাস। এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী বলেই ধারণা করা যায়। এই দুটো সমস্যা আন্তর্জাতিক মঙ্গার কারণে দেখা দিয়েছে। অথচ এই দুটো খাত আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগস্ট মাসে অবশ্য রেমিটেন্সে একটা জোয়ার এসেছে। জুলাই মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে রেমিটেন্স বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তা কোরবানির ঈদের জন্য, না মৌলিক কোন পরিবর্তনের জন্য তা বোঝা যাবে আগামী মাসে। যদি বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে আমাদের জন্য তা হবে মঙ্গলজনক। বাণিজ্য ঘাটতি যেমন দেখলাম ভারতে বেড়েছে, তেমনি আমাদেরও বেড়েছে। এর ফল আবার বাজারে খারাপ। রফতানি হ্রাস, রেমিটেন্স হ্রাসে বাণিজ্য ঘাটতি ও ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর চাপ পড়ে ডলারের ওপর। ইতোমধ্যে এর লক্ষণ বাজারে দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনেছে। কিন্তু আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। কারণ তা না হলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। অথচ আমাদের দরকার স্থিতিশীল বিনিময় হার। টাকা-ডলারের অস্থিতিশীল মূল্যমান আমাদের আমদানি-রফতানি এই দুটোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটা কাম্য নয়। ভারতের সরকারী ব্যাংকের ঋণ খেলাপী অবস্থা আমাদের মতোই। ভারতের ব্যাংকে নন-পারফর্মিং এ্যাসেটের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি ভারতীয় রুপী। শতকরা হিসেবে এটা আমাদের কাছাকাছিই। যে আলোচনাটি ভারতে বর্তমানে চলছে তা হচ্ছে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে চাকরি হচ্ছে না। অর্থাৎ ‘জবলেস গ্রোথ।’ এই সমস্যাটি আমাদেরও। এটা সরকারেরও কথা। আসলে বড় বড় প্রকল্পের বিনিয়োগ বড় ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না। কর্মসংস্থানের জায়গা হচ্ছে কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুঠির এবং মাঝারি শিল্প। বস্তুত কৃষিতেই বিরাট সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু এই দুটো খাতে আগের মতো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এমনকি যে পোশাক শিল্পে প্রতিবছর চাকরির সংস্থান হতো সেখানেও এখন তা আর হয় না। কারণ পোশাক শিল্পের মালিকরা প্রতিবেশীদের মতোই তাদের কারখানাকে আধুনিকায়ন করছে, রোবট বসাচ্ছে। এতে গত ৫ বছর যাবত এই খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি স্থবির হয়ে পড়েছে। দেখা যাচ্ছে ভারতের মতোই আমাদেরও বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবিরাবস্থায় আছে। বেসরকারী খাতের ঋণও হ্রাস পেয়েছে আমাদের, যেমন হয়েছে তাদের। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারী ঋণ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগের বছর এই হার ছিল ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে যা বাজার অর্থনীতিপ্রসূত এবং এই সমস্যা বিশ্বব্যাপীÑ শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের নয়। আর সেই সমস্যা হচ্ছে বৈষম্যের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির হারও বাড়ছে। কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে। ১৯৯১-২০০০ সালে ‘গিনি কোফিলিয়েট’ না দিয়ে বৈষম্য মাপা হয় তা ছিল শূন্য দশমিক ৪১। ২০০১-১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৫। সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের ৫ শতাংশ লোকের আয় ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে ছিল এক দশমিক ২ শতাংশ। সেই আয় ২০০৯-১০ অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে হয়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। উল্লেখ্য, এই রোগ বাজার অর্থনীতির। এটা বাংলাদেশ-ভারত নির্দিষ্ট কোন ঘটনা নয়। এ সমস্যা আবার বহুল চিহ্নিত। এর কোন সমাধান চিরায়ত পথে আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। পরিশেষে বলা দরকার মৌলিক সূচকগুলো ঠিক থাকলেও বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি নানা চাপের মধ্যে কাজ করছে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×