ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘুরে দাঁড়িয়েছে টাইগাররা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ঘুরে দাঁড়িয়েছে টাইগাররা

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ সবসময় প্রত্যাশা আর স্বপ্ন এক জায়গায় মেলে না। আর চট্টগ্রাম টেস্টে বোলারদের ওপর যেমন বিরূপ মনোভাব দেখাতে শুরু করেছিল জহুর আহমেদ চৌধুরীর উইকেট তাতে করে অলীক কল্পনাই ছিল বাংলাদেশের ম্যাচে ভালভাবে ফিরে আসা। কিন্তু এবার অন্তত হতাশ হতে হয়নি বাংলাদেশকে, খুব বড় কিছু করতে পারেনি সফরকারী অস্ট্রেলিয়া। আগের দিনের ২ উইকেটে ২২৫ রানের সঙ্গে তৃতীয় দিন মাত্র ১৫২ রান যোগ করতেই হারিয়েছে ৭ উইকেট। বাংলাদেশের ৩০৫ রানের জবাবে এখন অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৯ উইকেটে ৩৭৭। তৃতীয় দিনশেষে যদিও তারা এগিয়ে গেছে ৭২ রানে, কিন্তু বোলারদের দারুণভাবে খেলায় ফিরে এসেছে বাংলাদেশ দল। প্রত্যাশার প্রাপ্তি বলা যেতে পারে, যেটা সত্য করেছে পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের গতি-বাউন্স ও মেহেদি হাসান মিরাজের অফস্পিনের দ্বিমুখী আক্রমণের কল্যাণে। আর এই তৃতীয়দিনটায় মাত্র ৫৪ ওভারেই এই ফিরে আসার কৃতিত্ব দেখিয়েছে টাইগাররা। হয়তো পরিস্থিতি আরও ভাল হতে পারতো বাংলাদেশের ফিল্ডাররা তিনটি ক্যাচ ছেড়ে না দিলে। তৃতীয়দিনের সকাল থেকেই অবশ্য বন্দরনগরীর আকাশটা মুখ গোমড়া করে রেখেছিল, ম্যাচ শুরুর ৪৫ মিনিট আগে থেকে বৃষ্টিÑ যার কারণে মধ্যাহ্ন বিরতির আগে কোন বল গড়ায়নি মাঠে। বিরতির শেষেও ৩৫ মিনিট বিলম্বে ম্যাচ শুরু হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট বেশি খেলা হলেও নষ্ট হয়েছে ৩৬ ওভার, খেলা হয়েছে মাত্র ৫৪ ওভার। তবে এর মধ্যেই ভালভাবে ফিরেছে বাংলাদেশ দল। আগেরদিনটা যেভাবে অসি ব্যাটসম্যানরা শেষ করেছিলেন সেটা বড় ধরনের হুমকির মুখেই ফেলেছিল টাইগারদের। কারণ মাত্র ২ উইকেটে ২২৫ রান তুলে ফেলেছিল তারা, উইকেটে ভয়ঙ্কর ওয়ার্নার এবং উদীয়মান পিটার হ্যান্ডসকম্ব। দু’জনই নির্বিঘেœ তুলোধুনো করেছেন বাংলাদেশের স্পিনত্রয়ী সাকিব আল হাসান, মেহেদি হাসান মিরাজ আর তাইজুল ইসলামকে। পুরোপুরি বোলারদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সাগরিকার উইকেট। তাই শঙ্কা ছিল বড় একটি সংগ্রহ গড়ে বিশাল লিড নিয়ে বাংলাদেশকে চরম চাপে ফেলতে যাচ্ছে অসিরা। কিন্তু তৃতীয়দিন যেন স্বস্তির নাম হয়ে আসলো বৃষ্টি। দুরুদুরু অস্বস্তি আর আক্ষেপে ভরা ক্রিকেটপ্রেমী এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া বাংলাদেশের বোলাররাও যেন সুস্থির হতে পেরেছেন অবিরাম বর্ষণে। বৃষ্টি বাড়ছিল আর দর্শকদের চোখেমুখে এক অন্য রকম আলো ঝিলিক দিচ্ছিল। আকাশের গোমড়া মুখ আর দর্শকদের উদ্ভাসিত মুখ। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন ক্রিকেট খুব ভালভাবেই বোঝেন কারণ তাদের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে এই খেলাটি। অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে যেভাবে ব্যাট করছে সেটার কারণেই বাড়তি এই আনন্দ দর্শকদের মধ্যে। কারণ যেভাবে সাগরিকার উইকেট ব্যাটসম্যানদের পক্ষপাতিত্ব করেছে তাতে করে বড় একটি সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ দলকে চাপের মধ্যে ঠেলে দেবে। বৃষ্টির স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে কিছু সময় খেলা বন্ধ থাকলে অসিদের সেই ছন্দে পতন হবে। যত দেরিতেই খেলা, ততোই চাপে পড়া এবং টেস্ট ড্র হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। তাই বৃষ্টির মধ্যেও গ্যালারিতে আয়েস করে ভিজেছেন দর্শকরা, কোন ছাউনির আশ্রয়ে যাননি কেউÑ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে স্টেডিয়ামেও এসেছেন সময়মতো। মধ্যাহ্ন বিরতিরও ৩৫ মিনিট পর খেলা শুরু হয়। সবমিলিয়ে ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট কোন বল হয়নি। যতক্ষণ আলো, ততোক্ষণ খেল নীতি নিয়েই মাঠে নামেন আম্পায়াররা ও দুই দলের ক্রিকেটাররা। কিন্তু বৃষ্টির আর্দ্রতা কাজে লাগিয়ে দারুণ কিছু করার আশাটা ম্লান হয়ে গেছে ওয়ার্নার-হ্যান্ডসকম্ব আগের দিনের মতোই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালানো শুরু করলে। জুটিটা আরও বড় হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে এ দু’জনের একটি ভুল বোঝাবুঝি যার ফাঁদে পরে সেঞ্চুরির পথে থাকা হ্যান্ডসকম্ব রানআউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। তখন মাত্র দিনের দশম ওভার। ১৫২ রানের তৃতীয় উইকেট জুটি ভেঙ্গে যায়, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার এ উইকেটে সেরা জুটির রেকর্ড। হ্যান্ডসকম্ব ১৪৪ বলে ৬ চারে সাজঘরে ফেরেন ৮২ রান করে। চাপটা বাড়িয়ে দিতে দিনে প্রথমবারের মতো বল হাতে তুলে দেয়া হয় অফস্পিনার নাসির হোসেনের। কিন্তু ওয়ার্নারকে থামানো গেল না। তিনি ঠিকই ক্যারিয়ারের ২০তম শতকের পথে এগিয়ে যান। তবে নাসির বেশ ভুগিয়েছেন তাকে। ১৯৩ বলে ৯৯ রান করা ওয়ার্নার শতরান পেতে ব্যয় করেছেন ১৬ বলÑ যার সবগুলো ছিল নাসিরের বিরুদ্ধে। ইনিংসের ৭৪ ও ৭৬তম ওভারে ওয়ার্নারের বিরুদ্ধে মেডেন ওভার করেন তিনি। অবশেষে নাসিরের ১৬তম বল মোকাবেলা করে চার হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ওয়ার্নার। বব সিম্পসন, এ্যালান বোর্ডার, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইক হাসি (২ বার) ও মাইকেল ক্লার্কের পর ষষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ার হিসেবে এশিয়ার মাটিতে টানা দুই টেস্টে শতক হাঁকানোর কীর্তি দেখান। কিন্তু ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ধীরগতির শতক ছিল এটি তার (৩১৩ মিনিট ও ২০৯ বল)। শতক হাঁকানোর পরই নতুন বল নেয়ার সময় হয়ে যায় বাংলাদেশের। ৮১তম ওভারে নতুন বলে সাকিব শুরু করলেও পরের ওভারেই বল হাতে নেন মুস্তাফিজ। আর ঝলসে ওঠেন শুরু থেকেই। ৮৪তম ওভারে ম্যাক্সওয়েল সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত ১০ রানে, কিন্তু মিরাজ হাতছাড়া করেন। নিজের বলেই তিনি আবার ক্যাচ ফেলে দেন ৬ রানে থাকা হিলটন কাটরাইটের। ফিরতি ক্যাচটি ধরতে গিয়ে অবশ্য পাঁজরে তীব্র আঘাত পেয়েছিলেন মিরাজ। তবে ফিল্ডিংয়ের ব্যর্থতা তিনি পুষিয়ে দেন পরে তিনটি উইকেট শিকার করে। কাটরাইটকেই (১৮) তিন ওভার পর সাজঘরে ফিরিয়ে নিজের ভেল্কি শুরু করেন মিরাজ। শেষ বিকেলে সাগরিকার উইকেটে জমে ওঠে স্পিন। বলে ঘূর্ণি আসতে শুরু করে। নতুন বলে দুর্দান্ত বোলিং করা মুস্তাফিজকে অবশ্য টানা ৫ ওভার করিয়েই সরিয়ে নিয়ে রক্ষণাত্মক কৌশলের মুশফিক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। ১০৬তম ওভারে আবার ফিরিয়ে আনলে মুস্তাফিজ নিজের আরেকটি শিকার ধরেন। ২২ বছর পূর্ণ করা মুস্তাফিজ নিজের জন্মদিনে আইপিএল সতীর্থ ওয়ার্নারের উইকেট লাভের পর এবার এলবিডব্লিউ করে দেন উইকেটরক্ষক ম্যাথু ওয়েডকে (৮)। এরপর অবশ্য এ্যাশটন এ্যাগার কিছুটা লড়াই করেছিলেন ৪ রানে সৌম্যের কাছে সহজ ক্যাচ দিয়ে জীবন পেয়ে। কিন্তু সাকিবই তাকে ফিরিয়ে দিয়ে প্রথম সাফল্য পান ম্যাচে নিজের পঞ্চম স্পেলে বোলিং করতে এসে। এর আগেই মিরাজ ফিরিয়ে দেন ৩৮ রান করে হুমকি হয়ে উঠতে থাকা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে এবং প্যাট কামিন্সকে (৪)। মাত্র ১৫২ রান করতেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে অসিরা বাংলাদেশী বোলারদের দারুণ প্রত্যাবর্তনে। আর মাত্র ১ উইকেট তাদের হাতে এবং লিড ৭২ রানের। তৃতীয়দিনের শেষ বিকেলে স্পিন ম্যাজিক শুরু হওয়ায় আজ দ্রুতই সেই উইকেট তুলে নেয়ার স্বপ্ন টাইগারদের। সেক্ষেত্রে দ্রুতই বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে নামার পর মোকাবেলা করতে হবে ঘূর্ণি উইকেটে ভয়ঙ্কর অফস্পিনার নাথান লিয়নকে। তৃতীয়দিনে নষ্ট হয়েছে ৩৬ ওভার। সেটা পুষিয়ে নেয়ার জন্য আজ আধাঘণ্টা আগেই মাঠে গড়াবে বল। কিন্তু আবহাওয়া রিপোর্ট বলছে আজ এবং কালও থাকবে চট্টগ্রামে বৃষ্টি। বাংলাদেশী স্পিনারদের ফিরে আসাটা শেষ পর্যন্ত আবার ব্যাটসম্যানদের জন্য হিতে বিপরীত হবে কিনা সেটাও সময় বলে দেবে। তবে আপাতত তৃতীয়দিনটা অনেকখানি স্বস্তি নিয়েই শেষ করতে পেরেছে টাইগাররা।
×