ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযান

সাত মাথার খুলি ও পোড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সাত মাথার খুলি ও পোড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানী ঢাকার মিরপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে বুধবার বিকেলে সাতটি মাথার খুলি ও পুড়ে একপ্রকার কয়লা হয়ে যাওয়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো থেকে ডিএনএ’র আলামত সংগ্রহের জন্য পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। খুলী ও হাড়গোড়গুলো জঙ্গী আব্দুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই সহযোগীর বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে আব্দুল্লাহর ভাই খোকাকে ঢাকার মিরপুরের দিয়াবাড়ি থেকে আটক করেছে র‌্যাব। সেও জঙ্গীবাদে জড়িত কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। নিহত সাতজনের অধিকাংশের শরীরই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে। এজন্য সেগুলোর কোনটি কার লাশ তা তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হতে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়েছে র‌্যাব, র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ও ফায়ার সার্ভিস। আস্তানাটির আশপাশে বেশকিছু বাড়িতে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ উর্ধতন পুলিশ এবং র‌্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বুধবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার গভীর রাতে আস্তানাটিতে পরপর তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ছয়তলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্লোরে গর্ত হয়ে গেছে। যে জায়গাটিতে গর্ত হয়ে গেছে, সেখানে শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেমিক্যালের আগুন ফ্লোরের গর্ত দিয়ে চার তলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিস্ফোরণে প্রায় ৫শ’ মিটার বেগে বিস্ফোরক পদার্থগুলো চারদিকে ছিটকে পড়ে। এতে ভবনের পঞ্চমতলার জানালার থাইগ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। ভবনের ভেতরে আগুন ধরে যায়। আগুন পুরো পঞ্চম তলায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে থাকা কেমিক্যালেও আগুন ধরে যায়। কেমিক্যালের আগুনের কারণে সেখানকার সব জিনিসপত্র মানুষজন মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়। মানুষ পুড়ে অনেকটাই কয়লা হয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে কাউকে চেনার কোন উপায় নেই। ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়। র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বাড়িটির চতুর্থ তলা পর্যন্ত পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। পাঁচতলায় কক্ষগুলোতে অন্তত ৫০ থেকে ৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। বেশিক্ষণ সেখানে অবস্থান করা যাচ্ছিল না। এজন্য পঞ্চম তলা পরিষ্কার করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। পঞ্চম তলায় থাকা সব বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয়েছে। সেখানে আর কোন বিস্ফোরকের অস্তিত্ব প্রাথমিকভাবে মেলেনি। র‌্যাব প্রধান আরও জানান, জঙ্গী আব্দুল্লাহ ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়। আর ২০১৩ সালে যোগ দেয় নব্য জেএমবিতে। তার বাসায় জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়া হতো। সে জঙ্গীদের আশ্রয়দাতাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু আশ্রয় নয়, জঙ্গীদের অর্থের যোগান দিত আব্দুল্লাহ। তার বাসায় জেএমবির শীর্ষ নেতা সরোয়ার জাহান ও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম চৌধুরীর যাতায়াত ছিল। সরোয়ার-তামিম গ্রুপের একজন শূরা সদস্য কারাগারে আছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও আব্দুল্লাহ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। বছরখানেক ধরে আব্দুল্লাহর সন্ধান চলছিল। অবশেষে তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। জঙ্গী আস্তানাটি শনাক্ত হওয়ার কারণে এবং সফলভাবে অভিযান পরিচালিত হওয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেয়েছে। অন্যথায় বড় ধরনের নাশকতা ঘটে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। কারণ তার বাসায় যে পরিমাণ বিস্ফোরক ছিল, তা দিয়ে অনায়াসে বড় ধরনের নাশকতা চালানো সম্ভব ছিল। র‌্যাব মহাপরিচালক আরও জানান, আব্দুল্লাহ ওই বাড়ির ছাদে কবুতর পুষতেন। বিস্ফোরণে অনেক কবুতর মারা গেছে। যেগুলো জীবিত আছে, সেগুলোর পরিচর্যা করা হচ্ছে। নিরপরাধ দুটো বাচ্চা ছিল। নারী ছিল। র‌্যাবের তরফ থেকে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বাড়িটি ভাড়া নিয়ে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা বিস্ফোরক মজুদ করে রেখেছিল। র‌্যাব-৪ এর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আব্দুল্লাহর পিতার নাম মীর ইউসূফ আলী (মৃত)। বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। তারা সাত ভাই। তবে তার বোনের সংখ্যা জানা যায়নি। এক বোন মেহেরুন্নেছা মঙ্গলবার র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তিন ভাই ঈদ উপলক্ষে আব্দুল্লাহর বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আত্মসমর্পণকারী ওই নারী প্রতিবন্ধী। এদিকে বুধবার আব্দুল্লাহর আরেক ভাই খোকাকে মিরপুরের দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে। তবে খোকা জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত কিনা তা জানা যায়নি। সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খোকাও জঙ্গী আব্দুল্লাহর মতো কবুতর ও আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তিনি আরও জানান, আস্তানাটিতে জঙ্গী আব্দুল্লাহর (৪৫) দুই স্ত্রী নাসরিন (৩২) ও ফাতেমা (৩৫) এবং আব্দুল্লাহর দুই ছেলে ওমর (১০) ও আড়াই বছর বসয়ী ওসামা ছাড়াও দুই সহযোগী ছিল। আব্দুল্লাহ নব্য জেএমবির সদস্য হলেও সে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও তালেবান জঙ্গীদের অনুসারী। এজন্য সে তার দুই ছেলের নাম রেখেছে দুই শীর্ষ জঙ্গী নেতার নামে। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের (নিহত) নামের সঙ্গে মিল রেখে ছোট ছেলের নাম রেখেছেন ওসামা। আর তালেবান জঙ্গীদের প্রধান মোল্লা ওমরের (নিহত) নামে বড় ছেলের নাম রেখেছেন ওমর। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পনেরো বছর ধরে মিরপুর মাজার রোড এলাকায় ছদ্মবেশে বসবাস করছিল আব্দুল্লাহ। সে সেখানে কবুতরের ব্যবসার পাশাপাশি আইপিএস ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী মেরামতের কাজেও জড়িত ছিল। তার কক্ষে অন্তত ৫০টির মতো আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ছিল বলে ধারণা করছে র‌্যাব। এদিকে বুধবার সকাল নয়টা থেকেই আস্তানাটিতে অভিযান শুরু করে র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস আস্তানাটিতে প্রচুর পানি ঢালে। যাতে কোন প্রকার বিস্ফোরক থাকলে তা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর দফায় দফায় র‌্যাব সদস্যরা আস্তানায় অভিযান চালায়। আস্তানা থেকে আর কোন বিস্ফোরণের শব্দ মেলেনি। এরপর সেখানে প্রবেশ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। তারা ঘটনাস্থল থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করে। র‌্যাব বলছে, মারাত্মক বিস্ফোরণে বাড়িটির দরজা জানালা খুলে গেছে। দেয়ালের কিছু কিছু অংশ ধসে পড়েছে। অনেক আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোন কোন কক্ষে কিছু কিছু স্টিলের ও লোহার আসবাবপত্র ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ে আছে। পুরো এলাকা কর্ডন করে রেখেছে র‌্যাব। সেখানে সর্বসাধারণের যাতায়াত ও যানবাহন চলাচলের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে মিরপুরের মাজার রোডের পাশে বর্ধনবাড়ি ভাঙ্গা ওয়ালের গলির ২/৩-বি হোল্ডিংয়ে ছয় তলা ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে র‌্যাব। বাড়িটির পঞ্চম তলায় জঙ্গী আস্তানাটি সম্পর্কে র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল। বাড়িটির মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। তিনি টিএ্যান্ডটির সিবিএ নেতা। পাশাপাশি বাড়ির পাশের বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদের সহ-সভাপতি। তাকে আটক করেছে র‌্যাব। বাড়িতে জঙ্গী আস্তানা থাকার খবর শুনে তার স্ট্রোক হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আস্তানায় জঙ্গী আবদুল্লাহ তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই সহযোগীসহ মোট সাতজন অবস্থান করছে বলেও তথ্য ছিল র‌্যাবের কাছে। সোমবার রাতেই অভিযান শুরু করতে গেলে আস্তানা থেকে জঙ্গীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায়। অল্পের জন্য ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব সদস্যরা। অভিযান শুরুর পর থেকেই র‌্যাব ভেতরে থাকা জঙ্গীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। মঙ্গলবার সকালেই আব্দুল্লাহর এক প্রতিবন্ধী বোন মেহেরুন্নেছা আত্মসর্মপণ করে। এরপর থেকেই আব্দুল্লাহর আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে আস্তানায় থাকা সবাইকে আত্মসমর্পণের চেষ্টা করছিল র‌্যাব। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আব্দুল্লাহ আত্মসমর্পণ করতে রাজিও হয়। রাত আটটার মধ্যে সে আত্মসমর্পণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান। রাত দশটার দিকেও আত্মসমর্পণ করছিল না ভেতরে থাকা জঙ্গীরা। সেখানে অভিযান চালাতে গেলে ভেতর থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়। এতে চার র‌্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। তাদের তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এরপর থেকে আরও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে থাকে। সবমিলিয়ে বিকট শব্দে আস্তানায় অন্তত পাঁচ বার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পুরো আস্তানায় আগুন লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বোমা বিস্ফোরণের পাশাপাশি সেখানে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটে। রাত পৌনে বারোটার দিকে অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে র‌্যাব। বাড়িটিতে অভিযান চালানোর আগে বাড়িটির ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ১৫ জন শিশু, ২৪ জন নারী ও ২৬ জন পুরুষ সদস্যকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয় র‌্যাব।
×