ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এ মুহূর্তের অসুখ ধর্মের নামে বিভেদ - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

এ মুহূর্তের অসুখ ধর্মের নামে বিভেদ - স্বদেশ রায়

লাখ লাখ শিশু প্রতি বছর মারা যেত। এখন সে শিশু মৃত্যুর হার প্রায় শূন্যে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাজার হাজার মা মারা যেতেন। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখন অতি সামান্য। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দী, যে শতাব্দীতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়, ওই শতাব্দীতে পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে প্লেগে, স্মল পক্সে, কলেরাসহ নানা মহামারীতে। কোন কোন ছোট ছোট দেশের জনসংখ্যা অর্ধেক নামিয়ে দেয় ওই সময়ে এই সব মহামারী। মানুষ এই সব মহামারীকে জয় করেছে। গুটি বসন্ত নেই বলে ঘোষণা করেছে পৃথিবী। মানুষ জয় করেছে এই মহামারীকে। আর কলেরা। যা শুধু সারা পৃথিবীতে নয়, এই বাংলার গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করেছে, সে কলেরা দূর করতে এই বাংলাদেশের ভূমিকাও কম নয়। পৃথিবীর বিখ্যাত পত্রিকা কানাডার গ্লোব এ্যান্ড মেল ’৯০-এর দশকে লিখেছিল, বাংলাদেশ নামক দরিদ্র দেশটি শুধু সারা বিশ্ব থেকে সাহায্য নেয় না এরা পৃথিবীকে সাহায্যও করেছে। অনেক বড় সাহায্য করেছে। আফ্রিকার মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঠেকিয়েছে এই বাংলাদেশ তাদের হাতে তৈরি ওরস্যালাইন দিয়ে। তাই সারা পৃথিবী কলেরামুক্ত। এ মহামারী মুক্ত হতে বাংলাদেশেরও অবদান আছে। এখনও দু-একজন বয়স্ক লোক বাংলাদেশে আছেন যারা বলেন, ‘রাতের বেলা গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে ধ্বনি শুনলে বুঝতে পারতাম পাশে একজন কলেরায় মারা গেল।’ পলিওতে শুধু মৃত্যু নয় অর্ধ মৃত্যুর মতো অর্থাৎ পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকত লাখ লাখ মানুষ। সে পৃথিবী এখন আর নেই। পলিওর মৃত্যু ও পঙ্গুত্বমুক্ত এখন পৃথিবী। তারপরে এই আধুনিক সময়েও কি কম মহামারী আসেনি? ডেঙ্গু এসেছে, সার্চ এসেছে, চিকুনগুনিয়া এসেছে, এইডস এসেছে আর সর্বশেষ আসে এবোলা। না, কোনটাকেই ভয়ানক মহামারী হতে দেয়নি পৃথিবী। বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় এসব রোগে সারা পৃথিবীতে কয়েক হাজার মানুষ মাত্র মারা গেছে। এই মৃত্যু ঠেকাতেও প্রতিদিন বিজ্ঞান চেষ্টা করে যাচ্ছে। খোঁজ নিলে জানা যাবে বিজ্ঞানীদের এই মহতি চেষ্টার সঙ্গে বাঙালীও রয়েছে। যেমন পূর্ব এশিয়ায় সার্চকে রুখে দিতে অনেক বড় অবদান রেখেছে আমাদের বাংলাদেশের ছেলে বিজন শীল। ক্যান্সারকে রুখতে মানুষ ন্যানো টেকনোলজিকে কাজে লাগাতে একের পর এক চেষ্টা করে যাচ্ছে। চেষ্টা করে যাচ্ছে ডায়াবেটিসকে রুখে দিতে। সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। হয়ত কিছুদিনেই মানুষ তার সুফলও পাবে। এরপরে পৃথিবীতে মৃত্যুর আরেক কারণ রোড এক্সিডেন্ট। প্রতিদিন এই রোড এক্সিডেন্টে মানুষ মারা যাচ্ছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে। রোড এক্সিডেন্টকে ঠেকানোর জন্য যানবাহনের প্রযুক্তি উন্নত থেকে উন্নততর করতে তাই নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে যারা পঙ্গুত্ববরণ করছে তাদের জন্য তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। প্রতিনিয়ত সেগুলো উন্নত থেকে উন্নততর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সফলতাও আসছে প্রতিদিন। এখন অনেক কৃত্রিম অঙ্গ অনুভূতিসম্পন্ন হিসেবে তৈরি হয়েছে। এই সব মহামারীর সঙ্গে আরও একটি বড় মহামারী ছিল যা দুর্ভিক্ষ। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশের পাঁচ শতাংশ থেকে পনেরো শতাংশ মানুষ মারা গেছে দুর্ভিক্ষে। এই বাংলাদেশে ১৮৭২ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল ভয়াবহ- প্রকৃতি সৃষ্ট। অন্যদিকে ১৯৪৫-এর ইংরেজ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষÑ যার সাক্ষী শিল্পাচার্যের ছবি। পৃথিবী এখন দুর্ভিক্ষকে জয় করেছে। এই জয় করতে তাকে কাজে লাগাতে হয়েছে বায়ো টেকনোলজিকে। তেমনি পরিবহন, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি। আজ তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন আর বায়ো টেকনোলজির কল্যাণে পৃথিবী এমন স্থানে গিয়ে পৌঁছেছে যে, না খেয়ে মানুষ আর এ পৃথিবীতে মারা যাবে না। কেউ হয়ত একটু কম খাবে। কেউ হয়ত বড়জোর এই অনিশ্চিয়তায় থাকবে আগামী দিনের খাবারটি যোগাড় করতে পারব তো? এর বেশি আর নয়। বাংলাদেশেও আর কখনও দুর্ভিক্ষ হবে না। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা বায়ো টেকনোলজির মাধ্যমে সে কাজটি ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। এছাড়া দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক যেভাবে তৈরি হয়েছে আর সঙ্গে ইনফরমেশন টেকনোলজি তাতে আর দুর্ভিক্ষ সম্ভব নয়। যেমন বর্তমানে দেশের কয়েকটি চর এলাকায় বন্যা হওয়ার পরে একটি সংবাদপত্র তাদের তরফ থেকে সামান্য কিছু রিলিফ দিচ্ছে, তবে তার থেকে বড় কাজটি তারা করার চেষ্টা করছে যে মানুষ না খেয়ে আছে এমন কিছু দেখাতে। কিন্তু পারছে না। তাই বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে প্রায় সব মহামারী মানুষ পার হয়ে এসেছে। তবে তার পরেও পৃথিবী এখনও অসুস্থ, এখনও মৃত্যু, হত্যা, আর্তনাদ ভারি করছে পৃথিবীর বাতাসকে। বর্তমানে পৃথিবীতে যে মৃত্যু আর যে কারণে আর্তনাদে বাতাস ভারি হচ্ছে তার মূলে একমাত্র ধর্মের নামে বিভেদ। জওয়াহের লাল নেহরু জেলে বসে তার কন্যা ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন, এ যাবত পৃথিবীতে ধর্মের নামে যত মানুষ মারা গেছে এত মানুষ একক কোন মহামারীতে মারা যায়নি। অতীতের সেই ভয়াবহ ধর্মীয় উন্মাদনা এখন আর পৃথিবীতে নেই। তবে এ সত্য যে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পৃথিবী যতখানি ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে মুক্তি পেয়েছিল সেখান থেকে পৃথিবী আবার পিছিয়ে এসেছে। আজ পৃথিবীর নতুন অসুখ ও একমাত্র ভয়াবহ অসুখ তা ধর্মের নামে নরহত্যা ও ধর্মের নামে মানুষকে গৃহহীন করা। অতীতের পৃথিবীর তুলনায় এ অসুখ যে অনেক বড় তা বলব না, তবে বর্তমান সভ্যতা যেখানে গিয়েছে, মানুষের ইহজাগতিক সুখ যেখানে পৌঁছেছে, মানুষের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেখানে পৌঁছেছে, সর্বোপরি মানুষের চলাচল যেভাবে বেড়েছেÑ তাতে এ অসুখ মানুষকে মানায় না। একদিন চীনের সাগর পাড়ে ছিল অভাব আর শীতের কাঁপন। ক্ষুধা ও অপুষ্টি তাদের বাড়তে দিত না। এমনকি তাদের লোককথা বলে, ওই সাগর পাড়ের মানুষ মনে করত সাগরের ওপারেই পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। আর আজ তীব্র শীতে পেস্ট শহরের মাউন্টেনের মাথায় চড়ে শহর দেখার জন্য জড়ো হওয়া হাজারখানেক মানুষের ভেতর অর্ধেকই চায়নিজ। পৃথিবীর এমন কোন শহর নেই যে শহরের রাস্তায় একজন বাংলাদেশী পাওয়া যাবে না। তাই এই চলাচলের পৃথিবীতে, এই প্রযুক্তি উন্নয়নের পৃথিবীতে মানুষ যদি ধর্মের নামে একে অপরকে হত্যা করে, গৃহহীন করে- তার সংখ্যা পৃথিবীর সেভেন বিলিয়ন মানুষের তুলনায় যত কম হোক না কেন- তা মানায় না এই পৃথিবীতে। তাই বর্তমান পৃথিবীর সব থেকে বড় অসুখ, বড় সমস্যা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ। সেই বিভেদ- নরহত্যা, নিপীড়ন, বিতাড়নে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের এই অসুখ সারানোর দায়িত্ব বিজ্ঞানীদের নয় সবখানি। এর অনেক দায়িত্ব সমাজনেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের। গত কয়েক দশক থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে মিডিওকাররা সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তেমন বড় মাপের কোন নেতা আসছেন না যিনি বদলে দিতে পারেন মানুষের মনোজগতের এই সমস্যা, রাষ্ট্র ও সমাজের এই সমস্যা। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ধর্মের নামে যে বিভেদ, যে নরহত্যা, যে মানুষ বিতাড়ন এগুলো থামাতে হলে পৃথিবীতে এ মুহূর্তে দরকার সেই আধুনিক নেতার- যিনি অন্ধত্ব থেকে জাগতিক আলোয় মানুষকে নিয়ে আসতে পারবেন। যিনি এই জগতেই যে মানুষ সকল সুখের অধিকারী হয়ে উঠেছে এ সত্য মানুষকে বোঝাতে পারবেন। এই নেতা যদি পৃথিবী না পায় তাহলে ধর্মের নামে বিভেদের এই রক্ত আরও কিছুদিন থাকবে পৃথিবীতে। তবে বেশি দিন থাকতে পারবে না। মানুষ তার জীবনকে যেভাবে উন্নত করছে, চলাচলকে যেভাবে বাড়াচ্ছে তাতে আগামী দু-এক দশক পার হতেই একটি নতুন পৃথিবী আমরা দেখতে পাব। আজকের বাংলাদেশের তরুণদের তাই প্রস্তুত হতে হবে সেই পৃথিবীর জন্য। যাতে করে সেদিনের নেতৃত্বে থাকতে পারে এ দেশের তরুণরাও। [email protected]
×