ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁয় কারাম উৎসব

মাদলের তাল আর নাচে-গানে মুখর নাটশাল গ্রাম

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মাদলের তাল আর নাচে-গানে মুখর নাটশাল গ্রাম

বিশ্বজিৎ মনি “এই রাঙামাটির পথে লো, মাদল বাজে বাজে বাঁশের বাঁশি, ও বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগেনা কাজে লো, রইতে নারি ঘরে " আমার প্রাণ হলো উদাসী লো”—- এমন কতই না কথা আর কতই না সুরে নেচে-গেয়ে গোটা এলাকাকে মুখরিত করে তুলেছিল আদিবাসী তরুণীরা। নিজস্ব ভাষায় নিজস্ব সত্তায় তারা তাদের ধর্মীয় কারাম উৎসবে মেতে উঠেছিল। মাদলের তালে তালে নেচে-গেয়ে তারা পালন করল কারাম উৎসব। নওগাঁ অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘কারাম’ পালনের ২২ বছর পূর্ণ হলো বুধবার। এদিন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার নাটশাল গ্রামের ফুটবল খেলার মাঠটি যেন আনন্দে নেচে উঠেছিল। নানা সাজে সেজে-গুঁজে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা মাদলের তালে তালে নেচে-গেয়ে গোটা এলাকাকে মুখরিত করে তোলে। আদিবাসীদের সুরে সুর আর তালে তাল মিলিয়ে অনেক বাঙালীকেও মাঠে নাচতে চোখে পড়ে। উত্তরাঞ্চলের ওঁড়াও, সাঁওতাল, মুন্ডা, মালো, মাহাতো, ভুঁইমালি, পাহান, রাজোয়ারসহ নানা বর্ণ ও গোত্রের আদিবাসীরা হাজার বছর ধরে কারাম উৎসব পালন করলেও নওগাঁর এই নাটশাল মাঠে ২২ বছর আগে সাংগঠনিকভাবে শুরু হয় এই ধর্মীয় কারাম উৎসবের। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের উদিত চাঁদের পূর্ণিমার রাতে কারাম পুজো (ডালপূজা) পালন করে তারা। পূর্ণিমার রাতে (গত মঙ্গলবার) রাতভর চলে কারাম পুজো (ডালপূজা)। আর পরদিন আদিবাসী সমাবেশ, আলোচনা সভা ও নৃত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে এবারও কারাম উৎসব পালন করে। দু’দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে ছিল মঙ্গলবার রাতে ‘কারাম’ ডালে পুজো অর্চনা। এ উপলক্ষে আদিবাসী পরিবারগুলোতে আয়োজন করা হয় নানা ধরনের উন্নতমানের খানা-পিনার। সেই সঙ্গে তাদের নিজস্ব ভাষায় গান আর নাচ। খানা-পিনার পাশাপাশি এই নাচ-গানকে তারা তাদের ধর্মীয় উৎসব কারাম পুজোর অংশ হিসেবেই মেনে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। বুধবার সকাল থেকেই আদিবাসীদের গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠ। ধর্মীয় চেতনায় নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর, পতœীতলা, বদলগাছী, সাপাহার, পোরশা, নিয়ামতপুর, ধামইরহাট উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আদিবাসীরা নাটশাল খেলার মাঠে এসে সমবেত হতে থাকেন। বিকেল ৩টার মধ্যে মাঠ আদিবাসীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বিকেলে তারা শুরু করে তাদের ঐতিহ্যপূর্ণ নিজস্ব জাতিসত্তায় প্রচলিত গান ও নাচ। তরুণ-তরুণীরা একে অপরের হাত ধরে সারিবদ্ধ হয়ে কোমর দুলিয়ে মাদলের তালে তালে যখন নৃত্য শুরু করে, তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। হাজার হাজার দর্শক-জনতা মাঠের চারপাশে দাঁড়িয়ে এই নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করে। এই নাচ-গান চলে রাত অবধি। উদ্যমী ও কঠোর পরিশ্রমী আদিবাসীরাশিক্ষায় নিজেদের পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে না পারলেও সততা আর সরলতায় তারা অনেক এগিয়ে রয়েছে একথা বলতে দ্বিধা নেই। জোতদারের অনুর্বর জমিতে সোনালি ফসলে ভরে দিতে যে পরিমাণ শ্রম দরকার, কর্মঠ আদিবাসীরা তা দিতে কোন কার্পণ্য করে না। তাদের ঘামঝরা শ্রমে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য জোতদার, মজুতদার ও জমিদার গোষ্ঠীর। এই কারাম উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারেও নাটশাল মাঠে গ্রামীণমেলা বসে। খাবারের হরেক রকম মিঠাই সামগ্রীর পাশাপাশি দোকানিরা শিশুদের খেলনা, চুড়ি-ফিতা, প্রসাধনীসহ হরেক রকম মনভোলানো সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে সেখানে। বেচা-কেনাও হয় বেশ। শিশু ও তরুণীরা সেসব দোকানে ঝুঁকে পড়ে তাদের পছন্দের সামগ্রী কিনতে। সেখানে আদিবাসী আর বাঙালীদের যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। এই কারাম উৎসব উপলক্ষে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সেখানে আলোচনাসভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন অত্যন্ত দ্রুত গঠন করতে হবে এবং আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য কমপক্ষে একশ’ কোটি টাকার বাজেট রাখতে হবে। এবার কারাম উৎসবে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আদিবাসীদের অন্তত ২০টি নৃত্যদল অংশগ্রহণ করে।
×