ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ করুন ॥ মিয়ানমারকে প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ করুন ॥ মিয়ানমারকে প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখাইন রাজ্যের জনগণের ওপর সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন গণভবনে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে গেলে তিনি এ আহ্বান জানান। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, মিয়ানমারের এই বিপুলসংখ্যক নাগরিককে আশ্রয় দেয়া ও বাড়তি দায়িত্ব বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট বোঝা। তিনি বলেন, আমরা শুধুমাত্র মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিনা প্রিতিয়াসমিয়ারসি সোয়েমারনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাত করতে গেলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। এসব বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এই সমস্যা সমাধানে আমরা সহযোগিতা করব, তবে সবকিছুর আগে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। এই সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে, সামরিকভাবে নয়’। শেখ হাসিনা বলেন, কোন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে বাংলাদেশ কাউকে দেশের ভূখ- ব্যবহার করতে দিবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দু’দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে চায়। প্রয়োজনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমারে বিদ্রোহ বন্ধে সহযোগিতা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সহযোগিতায় ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যা সমাধান করেছে। শেখ হাসিনা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের উল্লেখ করে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশটিকে আমাদের সমস্যা বুঝতে হবে। আমাদের জন্য এটি একটি বড় ধরনের বোঝা’। প্রধানমন্ত্রী জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় বিপুলসংখ্যক শিশু, নারী ও বৃদ্ধ লোক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে’। তিনি কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এই রিপোর্ট সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করেছে, সেইভাবে এই সমস্যা সমাধান করতে মিয়ানমার সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া’। বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার দেশ ভূমিকা রাখতে চায়। বৈঠকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত রিনা প্রিতিয়াসমিয়ারসি সোয়েমারনো বলেন, তিনি ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের সেনা প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এই সহিংসতা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। রাখাইন রাজ্যে শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাখাইন জনগণের জন্য তার দেশ ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে। তিনি একইভাবে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর প্রস্তাব করেন। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী মিয়ানমারের এই নাগরিকদের মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তবে আমাদের নীতি খুবই পরিষ্কার যে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে কাউকে আমাদের ভূখ- ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে ১৯৭২ সালের মে মাসে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই সময় থেকেই উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিরাজ করছে। তিনি দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অধিকতর অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এতে দুই অঞ্চলের দেশগুলো আরও লাভবান হবে। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা যোগাযোগ, চার দেশের মোটরযান চুক্তি বিবিআইএন ও বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য তার সরকারের ১শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের উল্লেখ করে দু’দেশের পারস্পরিক স্বার্থে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইন্দোনেশিয়ার বিনিয়োগের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত মানবিক বিবেচনায় মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক নাগরিককে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। সোয়েমারনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিস্ময়কর আর্থসামাজিক উন্নয়নের গভীর প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনি হচ্ছেন বাংলাদেশের উন্নয়নের আলোকবর্তিকা।’ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে ইন্দোনেশিয়ার অনেক কিছু শেখার আছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, বিগত কয়েক বছর থেকে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বেড়ে চলছে। আমরা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে চাই। রাষ্ট্রদূত ইন্দোনেশিয়ায় শিল্প খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা এখন ৫০ আসনের উড়োজাহাজ বানাচ্ছেন। বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার বিনিয়োগ বাড়ছে এবং ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছে। দু’দেশের মধ্যে আকাশপথে সরাসরি যোগাযোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সোয়েমারনো। রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে ১৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে তার দেশের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগে ওষুধ কারখানা স্থাপনেও তার দেশের আগ্রহের কথা জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের সময় অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও বাংলাদেশে ইন্দোনেশিয়ার নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিনা প্রিতিয়াসমিয়ারসি সোয়েমারনো উপস্থিত ছিলেন।
×