ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লাস্টের পরামর্শ সভায় বক্তারা

আপত্তিকর জেরার ভয়ে আদালতে যেতে চায়না ধর্ষিতারা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আপত্তিকর জেরার ভয়ে আদালতে যেতে চায়না ধর্ষিতারা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২০০৮ সালে তামান্না (ছদ্মনাম) নিজ এলাকার একটি হোটেলে গণধর্ষণের শিকার হন। পরবর্তীতে পুলিশী মামলার পর যখন তিনি বিচারের আশায় উৎসাহ প্রকাশ করে আদালতের শরণাপন্ন হন তখনই তিনি মানসিকভাবে আরও নির্যাতিত হতে থাকলেন। কারণ, আইনজীবীদের নানা আপত্তিকর প্রশ্নের মুখে সে জর্জরিত। বিরুদ্ধ পক্ষের উকিলের মন্তব্য, ‘তিনি ধর্ষণের শিকার হননি। কারণ, তার আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিল এবং সে যে কোন যৌন সম্পর্কে অভ্যস্ত।’ পরবর্তীতে তামান্না তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার পেলেন না এবং অপরাধীরাও বেঁচে গেল। শুধু তামান্না নয় বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলার বাদীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে বিচার চাইলেই বিরুদ্ধ পক্ষ তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকে। বাদীকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই মূলত প্রতিপক্ষ এমনটা করে থাকে। আর আইনও অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা ওই নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে আখ্যায়িত করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে প্রতিপক্ষকে। আদালতে এভাবে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া দেখে অনেকেই বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে তারা আদালতের দ্বারস্থ হতে চায় না। এ জন্য অনেক ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয় না বরং অপরাধী পক্ষের কারণে ভীত হয়ে অনেক বাদীরা মামলা তুলে নিতে অথবা মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। মানবাধিকারকর্মী এমনকি বিচারপতিরাও এই সাক্ষ্য আইনের বিশেষ ধারাটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। রবিবার একটি ইংরেজী দৈনিকের কনফারেন্স হলে ব্লাস্ট আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচারে চারিত্রিক সাক্ষ্যের ব্যবহার’ বিষয়ক এক পরামর্শ সভায় উপস্থিত আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা ১৮৭২ সালে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা বাতিলের দাবি জানান। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেনÑ বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি নিজামুল হক (অব.)। সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। পরামর্শ সভায় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার নারীরা আদালতে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন যেটা আদালতে উপস্থিত বিচারক ঠেকাতে পারেন। বিরুদ্ধ পক্ষের উকিল যেন বাদীর চরিত্র নিয়ে বাজে কটূক্তি না করেন এ বিষয়টি তার আয়ত্তে থাকে। কিন্তু সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারার কারণে অনেক আইনজীবী বলেন, এটা আইনেই বলা আছে বাদীর চরিত্র নিয়ে কথা বলার বিষয়টি। আমার মতে, এই ১৫৫ (৪) ধারাটি থাকা উচিত নয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে বিচারের সময় মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য বিজ্ঞ আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।’ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক লুৎফা বেগম বলেন, ‘সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অভিযুক্তকে অব্যাহতি দিতে সাহায্য করে। অভিযোগকারীর চরিত্র কোন অবস্থাতেই ধর্ষণের অভিযোগ বিচারে বিচার্য বিষয় হওয়া কাম্য নয়।’ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৫-এর পিপি আলী আসগর স্বপন বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচারের আশায় অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় সে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। যৌতুকসহ নারীর প্রতি অন্যান্য সহিংসতার বিচারের ক্ষেত্রেও সাক্ষ্য আইনের এই ধারাটির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, যা ন্যায়বিচারের অন্তরায়।’ জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা বলেন, ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলা একটি দ্বৈত নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সংবিধানে নারী- পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও এই আইনটি নারী প্রসঙ্গে ঔপনিবেশিক ‘অধস্তন যৌনতার’ ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।’ ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে রাজধানীর কুড়িলে চলন্ত মাইক্রোবাসে আদিবাসী তরুণী ধর্ষণের ঘটনার পর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ধারাটি বাতিলের পক্ষে মত দেন। ওই সময় এক অনুষ্ঠানে তিনি সাক্ষ্য আইনের ওই ধারাটিকে কালো আইন হিসেবে উল্লেখ করে ব্লাস্টের পক্ষে ব্যারিস্টার নাওমি নাজ চৌধুরী বলেন, ‘এটি সংশোধনের দাবি তোলা দরকার।
×