ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্ত ৫৪ প্রজাতির দেশী মাছ নিয়ে গবেষণা, বাড়বে উৎপাদন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিলুপ্ত ৫৪ প্রজাতির দেশী মাছ নিয়ে গবেষণা, বাড়বে উৎপাদন

তাহমিন হক ববী প্রবাদ আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালী’। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খালবিল জলাশয়ে সময়মতো পানি না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তাই দেশী বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে আনতে গবেষণা চলছে। এই গবেষণায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা টেংরা মাছের বিপন্ন প্রজাতির কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও পোনা প্রতিপালন কলাকৌশল উদ্ভাবন করেছেন। চলতি বছরের জুনে মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত হস্তান্তর করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশী বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছ গবেষণার মাধ্যমে ফিরে আসছে। এতে মাছের উৎপাদন বাড়বে, ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে। ফিরে আসবে মাছে ভাতে বাঙালীর ইতিহাস। সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রটি ২০০৩ সালে প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উপকেন্দ্রে উত্তরাঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় ৫৪ প্রজাতির দেশী মাছ নিয়ে গবেষণা, জাত উদ্ভাবন, মাছ চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণ ও হাতেকলমে শিক্ষা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছেন তিন মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ১৭ কর্মচারী। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় দেশী জাতের মাছ চাষ প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে বর্তমানে ১৫ পুকুরে মাগুর, শিং, কৈ, রুই, কাতলা, জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড তেলাপিয়া, কালচে ও সাদা বর্ণের (গিফট) সরপুঁটি, টেংরা, ভেদা, শোল, টাকি, গুতুমসহ নানা দেশী বিলুপ্তপ্রায় মাছের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নের কাজ চলছে। পুকুরগুলোতে দেশী মাছের লাফালাফিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এরই মধ্যে টেংরার জাত উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসানের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ ও শওকত আহম্মেদ। গুতুম মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। টেংরা গবেষণা দলে থাকা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বলেন, মানুষ এখন বেশি বেশি সুস্বাদু দেশী টেংরা মাছ খেতে পারবেন। এ সাফল্যের পর দায়িত্ব-কর্তব্য আরও বেড়েছে বলেও মনে করেন তিনি। উপকেন্দ্রের প্রধান ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান জানান, টেংরা উদ্ভাবনের পর গুতুম মাছের জাত উদ্ভাবনও প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। এ উপকেন্দ্র থেকে সরকারী কর্মকর্তা, মাছচাষী, খামারিসহ প্রায় এক হাজার ২০০ জনকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন অনেকেই। তিনি জানান, মিঠাপানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদী-নালা, খালবিলে যে মাছগুলো পাওয়া যায়, তার মধ্যে টেংরা মাছ খুবই সুস্বাদু, অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ। কাটা কম থাকায় সকলের কাছে প্রিয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগে ডিম থেকে রেণু পোনা তৈরি করে ১০ দিনের মধ্যে পুকুরে ছাড়া হয়। এপ্রিল-আগস্ট টেংরা মাছের প্রজননকাল। এ সময় ৮/১০ গ্রাম ওজনের টেংরা সংগ্রহ করে পুকুরে মজুদ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রন্ড তৈরি করা হয়। রেণু পোনা ছাড়ার আগে পুকুর শুকিয়ে প্রথমে প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগের পাঁচদিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম টিএসপি ও চার কেজি গোবর ব্যবহার করা হয়। ব্রন্ড প্রতিপালন পুকুরের চারপাশে জালের বেষ্টনী দিতে হবে। একইসঙ্গে নির্দেশিকা মতো খাবার ও যতœ নিতে হয়। পুকুরে ছাড়ার ৮/১০ মাসের মধ্যে এ টেংরা খাবার উপযোগী হয়ে ওঠে। তাই হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্তপ্রায় দেশী জাতের মাছ ফিরিয়ে এনে তা চাষ করে চাষীরা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি আমিষসহ মাছের ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মোহাম্মদও সৈয়দপুরের স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, টেংরা মাছের প্রজনন, রেণু পোনা তৈরি ও লালন-পালনের প্রযুক্তি মৎস্য অধিদফতরের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফার্ম ম্যানেজারদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি দেশী জাতের এ টেংরা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
×