ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবহৃত হচ্ছে পদ্মা মহানন্দা পাগলা পুনর্ভবার জল

খাঁ খাঁ মরুভূমির বরেন্দ্রে উন্নয়নের ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

খাঁ খাঁ মরুভূমির বরেন্দ্রে উন্নয়নের ছোঁয়া

ডিএম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ বরেন্দ্রে বইছে নগরায়নের সুবাতাস। উত্তরাঞ্চলের দুটি বিভাগের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মরুকরণ প্রক্রিয়া থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে সহায়তা করেছে বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প। এখানে উল্লেখ্য, সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের অধিকাংশ সাধারণ কৃষক। শুধু সাধারণ নয় একেবারে প্রান্তিক। বরেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে মরুপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। মরুদ্যানের এক ফসলি জমিতে এখন তিন ফসলের সবুজের সমারোহ। তার মাঝে যত্রতত্র উঁকি দিচ্ছে নানান ধরনের শাকসবজি। বিশেষ করে টমেটো ও শিম বড় ধরনের কৃষি বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে এক শ্রেণীর কৃষককে। ফলে বরেন্দ্র প্রকল্পের কল্যাণে প্রায় সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিতে কৃষকরা তিন ফসলের আবার কোথাও কোথাও চার ফসলের বিপুল উৎপাদন করে কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের অভিমত বিএমডিএ না থাকলে এতদিনে মরুকরণ ঠেকানো খুবই কষ্টসাধ্য হতো। ১৯৮৫ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি ৯২ সালে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে ৮টি প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। ভূ-গর্ভস্থ পানির রিজার্ভ অক্ষত রাখতে অথচও বরেন্দ্রর সেচে পানি সরবরাহে নতুন দিগন্তের দিশা দিতে মাঠে নেমে অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পান। বিভিন্ন স্থানের খালবিলসহ পুকুরের রিজারভার প্রক্রিয়াকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সেচ কাজ অব্যাহত রেখেছে। বিএমডিএ সূত্র নিশ্চিত করেছে গ্রেটার রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলা বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হলেও বিএমডিএ এখন দুই বিভাগ ও উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছে। বিএমডিএ প্রথমদিকে প্রায় ১৩ হাজার ১৬৩ ডিপ টিউবওয়েলের সেচের মাধ্যমে ৪ লাখ কৃষককে উপকার করলেও এখন অর্থাৎ ডিপ নতুনভাবে বসানো বন্ধ করে খালবিল ও পুকুরের পানি ব্যবহারের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে সাড়ে পাঁচ লাখ কৃষক। যদিও পুরান ডিপ টিউবওয়েলে পানি প্রবাহ অনেক কমে গেছে তবুও কৃষক তা ব্যবহার করছে। ভবিষ্যতে বড় মাপের সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবার পানি ব্যবহার শুরু হলে আর প্রয়োজন পড়বে না ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার। এসব নদী থেকে পানি উত্তোলনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা প্রকল্প রয়েছে। শীঘ্রই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পানির ব্যবহার শুরু হলে এ সরকার বরেন্দ্রতে বড় ধরনের কৃষি বিপ্লব শুরু করতে পারবেন বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর মধ্যে প্রশিক্ষণ সব চেয়ে অধিক সাড়া জাগিয়েছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অনেকটাই মাটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছে বিএমডিএ। ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫০ কৃষক চাষবাসের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রশিক্ষণ বা কৃষি ট্রেনিংপ্রাপ্ত কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজারের বেশি হবে। জানা গেছে, ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিক পরিমাণ উত্তোলনের ফলে জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাকে সামনে এনে বিকল্প ব্যবস্থা হাতে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই। এরই অংশ হিসাবে ৮৩৪ ক্রসড্যাম নির্মাণ ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার ক্যানেল ও প্রায় তিন হাজার পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। যার কারণে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৯০ হেক্টর বোরো, ১ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর আমন এবং প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৫২৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য আবাদ হচ্ছে। এখানে একাধিক লো-লিফট পাম্প ব্যবহার করে আবাদ সুবিধা দেয়া হচ্ছে প্রায় হাজার একর জমিতে। বরেন্দ্রর ২৫ উপজেলায় এ ধরনের এলাকাজুড়ে প্রায় ৪০০ খাড়ি বা খাল রয়েছে। এগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। এসব খাল খনন না করায় হাজামজা বা ভরাট হয়ে আছে। কিন্তু জরিপ করতে গিয়ে এসব খাড়ির অস্তিত্ব মিলেছে। মরুসদৃশ বরেন্দ্রতে প্রাচীন খাল হিসেবে এর একটা ঐতিহাসিক বড় ধরনের পটভূমিও রয়েছে। গোদাগাড়ীতে ৭৩ কিলোমিটার, তানোরে ৭৫ কিলোমিটার, মোহনপুরে ৩১, চাঁপাইয়ে ২৭, নাচোলে ৫৮, মহাদেপুরে ১৩০, পত্মীতলায় ১০০, সাপাহারে ৭০, পোরশায় ৯০, নিয়ামতপুর ১২০, ধামুইরহাটে ২৭, মান্দা ও বদলগাছীতে ২০ কিলোমিটার করে খাল রয়েছে। এসব উপজেলা আদি বরেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। পানির মূল উৎস ছিল এসব এলাকার খালগুলো। বরেন্দ্রতে বন্দোবস্ত পুকুর রয়েছে ১৪ হাজার। বরেন্দ্রর ২৫ উপজেলায় এ পর্যন্ত মাত্র দুই হাজার পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। বাকিগুলো এখনও হাজামজা। কোন কোন ক্ষেত্রে ভরাট করে দখল নিয়ে জমি করা হয়েছে। সংস্কার করা পুকুরগুলো একদিকে সেচে সহযোগিতা দিচ্ছে অপরদিকে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতিরও সহায়ক হয়েছে। ফলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা বরেন্দ্রর পরিবেশ রক্ষায় নামে অন্য কোন প্রকল্প গ্রহণে অর্থের অপচয় রুখে দেবে, সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের সখ্য বৃদ্ধি পাবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
×