ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বিশ্বকে বদলে দিতে চলেছে ব্যাটারি শিল্প

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিশ্বকে বদলে দিতে চলেছে ব্যাটারি শিল্প

মোটর গাড়ি শিল্পে আজ যে ব্যাপক রূপান্তর ঘটছে, ইন্টারনাল কমবাস্টন ইঞ্জিনের গাড়ির জায়গায় ইলেকট্রিক গাড়ির যে বিশাল পরিসরে প্রচলন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবস্থার অবিস্মরণীয় সম্প্রসারণ। বলা যেতে পারে এই ব্যাটারি শিল্প দুনিয়াকে বদলে দেয়ার উচ্চাভিলাষ নিয়ে এসেছে। বিদ্যুত কোম্পানিগুলোর বিদ্যুত মজুদ রাখার ও চাহিদা বৃদ্ধির সময় তা ছেড়ে দেয়ার ভাল ব্যবস্থা হতে পারে এই ব্যাটারি। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি প্রথম বিক্রি শুরু হয় ২৬ বছর আগে সনি কোম্পানির ক্যামকর্ডারে। শুরুতেই বাজারমাত। অচিরেই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি কম্পিউটার, ফোন, কর্ডলেস পাওয়ারটুল, ই-সিগারেট ও আরও অনেক কিছুতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বে যত বেশি সাজসরঞ্জাম ব্যবহার হচ্ছে তত বেশি আজ প্রয়োজন হয়ে পড়ছে এই ব্যাটারির। গত বছর ভোগ্যপণ্যের জন্য যত লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন করতে হয়েছে সেগুলোর মোট বিদ্যুত ধারণক্ষমতা ছিল ৪৫ গিগাওয়াট-আওয়ার। ব্রিটেনে গড়ে প্রায় ৩৪ গিগাওয়াট-আওয়ার বিদ্যুত প্রয়োজন। সুতরাং ওইসব ব্যাটারির সবই চালু করা হলে সেগুলো দিয়েই ব্রিটেনকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুত যোগানো যেত। একই বছর ইলেকট্রিক কারের জন্য লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন ওই ক্ষমতার অর্ধেকের কিছু বেশিতে ২৫ গিগাওয়াট-আওয়ারে পৌঁছায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারির চাহিদা আগামী বছরের প্রথমদিকে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর ব্যাটারির চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাবে। তার মানে এই ব্যাটারি শিল্পের বিশাল সম্প্রসারণ ঘটতে চলেছে। বিশ্বে লিথিয়াম ব্যাটারির শীর্ষ পাঁচ প্রস্তুতকারক কোম্পানি হলো জাপানের প্যানাসনিক, দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি কেম ও স্যামসাং এসডিআই এবং চীনের বিওয়াইডি ও সিএটিএল। এরা সবাই উৎপাদন বাড়াতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। মোটর কোম্পানি টেলসা নেভাদায় প্যানাসনিকের সঙ্গে যৌথভাবে ৫শ’ কোটি ডলারের যে বিশাল গিগাফ্যাক্টরি তৈরি করছে ইতোমধ্যে সেটিতে বছরে ৪ গিগাওয়াট-আওয়ার এনার্জি তৈরি হচ্ছে। টেলসা বলছে যে, তাদের টার্গেট বছরে ৩৫ গিগাওয়াট-আওয়ার তৈরি করা। মাত্র ৪ বছর আগে এটাই সারা বিশ্বের সমস্ত যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। গিগাফ্যাক্টরি শুধু গাড়ির জন্য নয়। গ্রিডকে বিদ্যুতের যোগান দেয়াও তার লক্ষ্য। টেলসা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ায় তার গ্রিডভিত্তিক বৃহত্তম বিদ্যুত স্থাপনা তৈরি করছে। এমনই স্থাপনা অন্যরাও অন্যান্য জায়গায় তৈরি করছে। বড় বড় কোম্পানি লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়ায় এর ইউনিটপ্রতি খরচ কমে আসছে। ২০১০ সালে ব্যাটারির মূল উপাদান লিথিয়াম-আয়ন সেলের খরচ ছিল কিলোওয়াট আওয়ারপিছু এক হাজার ডলারের বেশি। গত বছর সেই একই ইউনিটের খরচ ছিল ১৩০ থেকে ২শ’ ডলারের মধ্যে। টেলসা জানিয়েছে যে, তার মডেল ৩ সেলের খরচ আরও কম। খরচ কমে যাওয়াটাই যে একমাত্র উন্নতির বিষয় তা নয়। গবেষণা ও উন্নয়নে (আর এ্যান্ড ডি) বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগের পরিণতিতে বিদ্যুত শক্তির ঘনত্ব বেড়ে গেছে অর্থাৎ কিলোগ্রামপিছু অধিক পরিমাণ শক্তি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে এবং টেকসই ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বোল্ট কোম্পানি এমন ব্যাটারি নিয়ে এসেছে যার ওয়ারেন্টি ৮ বছর। উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় ব্যাটারি শুধু যে দামে সস্তা হচ্ছে তা নয়, এর গুণগত মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর শক্তি ধারণক্ষমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে কারখানার ব্যাটারি উৎপাদন ক্ষমতাও। এক হিসাবে দেখা যায় যে, গত বছর লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন চাহিদার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ বেশি হয়েছে। বাজার লিথিয়াম ব্যাটারিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় কিছু কোম্পানি লোকসান গুনেছে অথবা নামমাত্র মুনাফা করেছে। কিন্তু তারপরও বেশিরভাগ বড় কোম্পানি তাদের কারখানা ও বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য হলো দাম আরও কমিয়ে আনা। এতে নিকট ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য আরও বেশি আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ এতে এই গাড়ির দাম আরও কিছু কমবে এবং বিক্রি বাড়বে। অতি আশাবাদীরা এমনও বলেন যে, আমেরিকায় এক সময় মানুষ যেমন সোনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল, তেমনি নিকট ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক গাড়ির জন্যও হুমড়ি খেয়ে পড়বে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির জন্য কিছু মূল্যবান খনিজ উপাদান প্রয়োজন। যেমন লিথিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি। একটা সেল তৈরির খরচের ৬০ শতাংশ এসব উপাদানের পেছনেই চলে যায়। এসব উপাদানের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। লিথিয়ামের দাম ২০১৫ সাল থেকে চারগুণ বেড়েছে। ক্যাথোড তৈরির জন্য যে কোবাল্ট দরকার সেটির দামও একই সময় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ক্যাথোডের আরেক উপাদান নিকেলের দামও বাড়ছে। বিশ্বে লিথিয়ামের মজুদ কমপক্ষে ২১ কোটি টন বলে ধরা হয়। বর্তমানে বার্ষিক আহরণ হচ্ছে ১ লাখ ৮০ হাজার টন। বিশ্বে সর্বাধিক লিথিয়াম উৎপাদক দেশ চিলি। কোবাল্ট সেই তুলনায় দুষ্প্রাপ্য। বেশিরভাগ সরবরাহ আসে কঙ্গো থেকে। দুষ্প্রাপ্যতার কারণে কোন কোন কোম্পানি কোবাল্টের বিকল্প সন্ধান করছে। তা ছাড়া পুরনো ব্যাটারির উপাদানগুলো রিসাইক্লিং করে ব্যাটারি শিল্পকে আরও বেশি টেকসই করে তোলা যেতে পারে। লিথিয়াম ব্যাটারির দাম ও ওজন, এর বারবার চার্জ ও ডিসচার্জ করার ক্ষমতা, এর টেকসই ক্ষমতা ও নিরাপত্তার কাছে অন্য কোন ব্যাটারি ধারেকাছে ভিড়তে পারে না। তাছাড়া এই ব্যাটারির প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত উন্নতি ঘটানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইলেকট্রিক গাড়ির লিথিয়াম ব্যাটারি হচ্ছে সিলিন্ডারের মতো একটি সেল, যাকে বলা হয় ১৮৬৫০। দেখতে রাইফেলের খোলের মতো। এটি ৬৫ মিলিমিটার লম্বা, ব্যাস ১৮ মিলিমিটার এবং এর এনার্জি ঘনত্ব সম্ভবত কিলোপ্রতি ২৫০ কিলোওয়াট-আওয়ার। সে তুলনায় পেট্রোলের এনার্জি ঘনত্ব প্রায় ৫০ গুণ বেশি। তবে ব্যাটারি সেলটি সেই পরিমাণ এনার্জির কয়েক শ’ বা কয়েক হাজার গুণ বেশি। টেলসা ও প্যানাসনিক এখন নতুন এক লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরি করেছে। ২১৭০ নামের এই ব্যাটারি একটু বেশি লম্বা ও চওড়া। এটি হবে বাজারের প্রাপ্তিযোগ্য সর্বাধিক এনার্জি ঘনত্বসম্পন্ন ব্যাটারি। এই ব্যাটাারির কারণে টেলসা কোম্পানির মডেল ৩ ইলেকট্রিক গাড়ির খরচ আগের যে কোন গাড়ির তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসবে। টেলসার প্রতিষ্ঠাতা এলোন মুস্ক আশা প্রকাশ করেছেন যে, তাদের যে গিগাফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছে সেটি হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইমারত যেখান থেকে বছরে এক শ’ গিগাওয়াট-আওয়ার এনার্জি বেরিয়ে আসবে। অন্যান্য স্থানে আরও গিগাফ্যাক্টরি তৈরি হতে যাচ্ছে। পরবর্তীটি সম্ভবত হবে চীনে। এসব আয়োজন থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ইলেকট্রিক গাড়ির যুগ এসে গেছে। সন্দেহ নেই এই গাড়িগুলো দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে এবং দামেও হচ্ছে সস্তা। তবে সেগুলোর ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতাও থেকে যাচ্ছে। ব্রিটেনের কথাই ধরা যাক। সেখানে ৪৩ শতাংশ ইলেকট্রিক গাড়ির মালিকের অব স্ট্রিট পার্কিংয়ের সুবিধা নেই। তাছাড়া ঘরে ব্যাটারি চার্জ করার ব্যবস্থা নেই। ৯০ কিলোওয়াট-আওয়ারের ব্যাটরি চার্জ করার জন্য দরকার ১১ কিলোওয়াটের চার্জার। সময় লাগবে ৬ ঘণ্টা। সুতরাং বাসাবাড়িতে চার্জ করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার দ্রুত ব্যাটারি চার্জ করার মতো স্টেশন, অনেকটা পেট্রোল স্টেশনের মতো। সেটা কত দিনে সম্ভব হবে সেটাই প্রশ্ন। টেলসা ও অন্য বড় ব্যাটারি প্রস্তুতকারকদের গ্রিড স্টোরেজ প্রকল্পগুলো এখন বিদ্যুতের বাজারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। এগুলো উদ্বৃত্ত এনার্জি কাজে লাগানোর জন্য কন্ট্রাক্ট অফার করছে। টেলসার ব্যাটারি সোলার প্যানেল ও সোলার টাইলের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। লিফ কোম্পানির ব্যাটারিও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানায় ব্যাকআপ বিদ্যুত যোগাতে পারে এবং এভাবে বায়ুদূষণকারী ডিজেল জেনারেটরের স্থান দখল করতে পারে এই ব্যাটারি। আমেরিকার কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এমন ব্যাটারি স্থাপনে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যেগুলো জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত বিক্রি করতে পারে। এটা হলো পিকআওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের একটি উপায়। তবে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহারে কিছু বিপত্তিও রয়েছে। একটি হলো অগ্নিকা-ের ঝুঁকি। গত বছর স্যামসাং গ্যালাক্সি ‘নোট-৭’ স্মার্টফোনে বিস্ফোরণের ঘটনা বিশ্ববাসীকে সাবধান করে দিয়েছে যে, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন হলে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লেগে যেতে পারে। অবশ্য নতুন উপাদানের ব্যবহার এবং ইলেকট্রোডগুলোর সিরামিকের কোটিং থাকায় গাড়ির ক্ষেত্রে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি নিরাপদ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×