ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না

ইউরোপের পথে ফের ৪শ’ বাংলাদেশী লিবিয়ায় আটক

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ইউরোপের পথে ফের ৪শ’ বাংলাদেশী লিবিয়ায় আটক

ফিরোজ মান্না ॥ আবার ইউরোপে পাড়ি দেয়ার পথে চারশ’র বেশি বাংলাদেশী নাগরিক লিবিয়ায় আটক হয়েছে। গত মাসের শেষ দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পর লিবিয়া হয়ে সাগর পথে বেশি মানব পাচার হচ্ছে। চার শ’ বাংলাদেশী নাগরিককে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে দালাল চক্র লিবিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাচার হওয়া নাগরিকদের ভাগ্য বিড়ম্বনায় তাদের লিবিয়ার পুলিশের হাতে আটক হতে হয়েছে। ফলে তাদের আর ইউরোপ যাওয়া হয়নি। এখন তাদের স্থান হয়েছে লিবিয়ার কারাগারে। সূত্র জানিয়েছে, দেশে মানব পাচার রোধে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না। দালালদের খপ্পরে পড়ে বিপজ্জনক পথে পাচার হতে গিয়ে অনেকে মারা পড়ছেন। আবার অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে সাগর পথে মানব পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। মালয়েশিয়াতেও ট্রলারযোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখনও অনেক মানুষ পাচার হচ্ছেন। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক নিরীহ মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু পাচারকারী কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে সক্ষতা রয়েছে। এ কারণেই পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মানব পাচার বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোন কাজ হচ্ছে না। মানব পাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালে মাধমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখানে থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রেফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এখন শুরু হয়েছে লিবিয়াতে পাচার। লোভ দেখানো হচ্ছে-লিবিয়া থেকে সাগর পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরির। লোভে পড়ে মানুষ দালালদের ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনে চলে যাচ্ছে। কেউ হয় তো লক্ষ্যে পৌঁছিতে পারে। তবে বেশির ভাগই ঠাঁই হয় বিভিন্ন দেশে জেলখানায়। অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সার্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কাযক্রম নেই। এছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থসামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসংগতি মানব পাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, মানব পাচার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটবে। সমাজে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম নেবে। এখন থেকে বের হতেই হবে। তানা হলে জনশক্তির বাজারও হারাতে হবে। প্রতি বছর পাচার হওয়া নারী পুরুষের প্রকৃত সংখ্যা কত তা সরকারী-বেসরকারী কোন সংস্থার কাছে নেই। সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলো সংবাদ মাধ্যম থেকে যে সংখ্যা পাওয়া যায় তারই হিসাব রাখা হয়। এর বাইরে আর কোন কাজ হচ্ছে না। দেশে লোকসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এ বিষয় নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বেসরকারী সংস্থাগুলো মাঝে মধ্যে মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে বছরে দু’চারটি সেমিনার করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। পাচার হওয়া পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
×